Wednesday, December 30, 2015

আধুনিক সিঙ্গাপুরের স্থপতি লি কুয়ান ইউ’র নেতৃত্বের ধরণ



সিঙ্গাপুর নামক রাষ্ট্রটি ক্ষুদ্র দ্বীপখন্ড বা দ্বীপখন্ডসমূহের সমষ্টি। প্রায় ৫৫ লাখ জনঅধ্যুষিত এই রাষ্ট্রটি বিশ্বের আর ২০০টি রাষ্ট্রেরই মতো একটি রাষ্ট্র। ১৯৬৫ সালের ০৯ আগস্ট এই রাষ্ট্রটি মালয় ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতা ঘোষনার সময় এই রাষ্ট্রটি বলতে গেলে একটি জেলে পল্লী মাত্র ছিল। লি কুয়ান ইউ তখন ছিলেন সেই জেলেপল্লীসম দ্বীপখন্ড বা দ্বীপখন্ডসমূহের ২০ লাখ মানুষের নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী। তার নেতৃত্বে সেই রাষ্ট্রটি মাত্র কয়েকবছরের মধ্যে উন্নতশীল ও বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে চলে আসে।সিঙ্গাপুরকে তিনি যেমন ন্যায়সংগত শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করান তেমনি তিনিও পরিচিতি লাভ করেন বিশ্বের মাঝে শক্তিশালী একজন রাষ্ট্রনায়ক তথা সরকার পরিচালক হিসেবে।
তাঁর সরকার পরিচালনার ধরণ বা তাঁর নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য বা নেতৃত্বের ধরণ নিয়েই এই আলোচনা। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরাও যদি কিছুটা শিক্ষা অর্জন করতে পারি তবে নিশ্চয়ই এই প্রচেষ্টা সার্থক হবে বলে আশা।
এখানে আমি মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক কর্তৃক ভাষান্তরকৃত লি কুয়ান ইউ’র আত্মকথা ‘ফ্রম থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফাস্ট ফাস্ট; সিঙ্গাপুরের ইতিহাসঃ ১৯৬৫-২০০০’ বই থেকে লেখার সারবস্তুসমূহ সংগ্রহ করেছি এবং তথ্যসহ উদ্ধৃতিসমূহও এই বই থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে।

বয়োকনিষ্ঠ নেতা থেকে সুযোগ্য রাষ্ট্র পরিচালক
লি কুয়ান ইউ যখন সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তার সাথে থাকা সহযোগীদের চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ ছিলেন।
তিনি ১৯৫৯ সালের দিকে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে স্বায়ত্তশাসিত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে যখন সিঙ্গাপুর মালয় ফেডারেশন থেকে স্বাধীন হয় তখন তার বয়স ছিল ৪২ বছর। তিনি ছিলেন তার সহকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী। দায়িত্ব গ্রহণ বিষয়ে তিনি লিখেছেন স্মৃতি কথায় লিখেছেন- ‘আমি তাঁদের সকলের চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ ছিলাম। তারপরেও তাঁরা কখনো আমার  কোনো বিষয়ে বাধা দেননি, নিজেদের  সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি। এমনকি আমি যখন কোনো ভুল করেছি তখনও তাঁরা আমার বিরোধিতা করেননি। তাঁরা সবসময় আমাকে ভারসাম্যপূর্ণ ‍অবস্থানে অবস্থান করতে সহায়তা করেছেন এবং আমার ভেতরে যেন ‘মুই কি হনু রে’ জাতীয় ঝুঁকিপূর্ণ আত্মম্ভরিতার বিকাশ না ঘটে সে বিষয়ে সচেতন থেকেছেন।’(পৃ:২৯৪)
তিনি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তার কিছু কিছু আমি নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।


সুশাসনের জন্য সুনেতৃত্ব অত্যাবশ্যক
তিনি সরকার বা রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে একই সাথে ভালো লোক ও সুনেতৃত্বের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলছেন- ‘আমি দেখেছি, সুগঠিত সরকার কাঠামোও যদি মন্দ লোকের দ্বারা পরিচালিত হয় তাতে করেও জনগণের ক্ষতিই সাধিত হয়। অন্যদিকে আমি অনেক সমাজে সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতা সত্ত্বেও সুনেতৃত্বের বদান্যতায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা হতে দেখেছি।’
এদিক থেকে তিনি ভালো একজন প্রশাসক ও সুনেতা অবশ্যই ছিলেন। প্রশাসন পরিচালনার সময় তিনি যেমন দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি করেননি তেমনি তার প্রশাসন বা সরকারে যেন সে ধরণের কিছু চলতে না পারে সে ব্যবস্থা তিনি করার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে তাকে আপাতভাবে নানা ‘বিতর্কিত’ সিদ্ধান্তও অনেক ক্ষেত্রে নিতে হয়েছে।
তিনি বলছেন- ‘… আমাদের মন্ত্রীপরিষদের  সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী ছিলাম। অফিসের বাইরে আমাদের কোনো বৃত্তিগ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। আমাদের সকলের স্ত্রী উপার্জন করতেন, আমরা জেলে গেলে কাছাকাছি না থাকলে তাঁদের অর্থেই সংসারের খরচাপাতি মেটানো হত। এভাবেই আমাদের মন্ত্রী এবং তাঁদের স্ত্রীদের মানসিক গঠন গড়ে উঠেছিল। এ ধরণের পরিবেশে মন্ত্রীগণ যখন জনতার প্রতি আস্থাশীল থেকে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করত তখন আমলারাও নির্ভীক চিত্তে মাথা উঁচু করে আস্থার সাথে সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন।’(পৃঃ১৯৭)
তাঁর এবং তাঁর সহকর্মীদের এই ক্লিন ইমেজের কারণে তারা জনগণের মাঝে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
তিনি মন্ত্রীদের বেতন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া একনাগারে যারা ১০ বছরের মতো সংসদ সদস্য থাকতেন তাদের জন্য তনি পেনশনের  ব্যবস্থা করেছিলেন।
একইসাথে তিনি দেখেছেন, সাধারণভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হতে প্রার্থীদের বিস্তর খরচ করতে হত। এতে তারা নির্বাচিত হবার পরে সেই অর্থ আবার তুলে আনতে নানা ধরণের অনিয়মে জড়িত হতেন।
তিনি বলছেন- ‘বিশুদ্ধ সরকারের একটি অপরিহার্য শর্তই হচ্ছে নির্বাচনে অধিক ব্যয় না করা, কারণ ব্যয়িত অর্থ পুনরূদ্ধারের জন্য দুর্নীতির চক্রে আবর্তিত হতে হয়। এশিয়ার অধিকাংশ দেশের ধ্বংসের মূলে রয়েছে নির্বাচনে বেপরোয়া ব্যয়।’(পৃঃ ২০৩)
তিনি বলছেন- ‘নির্বাচনে অনাহুত ব্যয় করে কোনো সরকারই সততা রক্ষা করতে পারে না, এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর একটি পরিচ্ছন্ন পদ্ধতি প্রবর্তন করে সততার নজির স্থাপন করেছে।’(পৃঃ২০৩)


সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্ব সমর্পন
প্রশাসন বা সরকার বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিক বা দক্ষ যোগ্য ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্ব প্রদান করা সম্ভব হলে সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়। তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তাঁর নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। তিনি বলছেন- ‘যখনই আমি সঠিক ব্যক্তিকে কোনো দায়িত্বে ন্যস্ত করতাম তখনেই আমার ঘাড় থেকে একটি বোঝা নেমে যেত। আমি দায়িত্ব অর্পণকারীদের শুধু বিষয়বস্তু এবং কতদিনের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করতে হবে সে-সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা প্রদান করতাম, কাজটি সম্পাদনের তরিকা তারাই উদ্ভাবন করে তা সম্পন্ন করতেন।’
এভাবে তিনি সতর্কতার সাথে তার সহকর্মীদের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত করতে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন।কোন ব্যক্তি কী ধরণের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এ বিষয়ে সম্ভবত তাঁর সুচারু ধারণা বা জ্ঞান ছিল বলা যায়।

যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা
লি কুয়ান ইউ তার এক সহকর্মী’র গুণবাবলী সম্পর্কে বলছেন- ‘আমার মন্ত্রীদের মধ্যে হোন সুই সেন উপযুক্ত লোকবল অনুসন্ধানের কাজে সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন।’(পৃঃ ২৭৫)
তিনি গোহ চক তং-এর মতো একজন করিৎকর্মা নির্বাহীকে খুঁজে বের করেছিলেন। পরে গোহ চক তং প্রধানমন্ত্রী পদ অলংকৃত করেছিলেন।তিনি সুই সেন ও ডঃ তনি তান-এর মতো ব্যক্তিত্বকেও রাজনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত করেছিলেন। এই দুইজন পরবর্তিতে উপপ্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন।
এছাড়া সংযুক্ত করেছিলেন এস ধনবালানের মতো প্রজ্ঞাবানকেও। যিনি পরে সিঙ্গাপুর উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

নেতৃত্বের জন্য মেধার সাথে আরো যা কিছু প্রয়োজন
নেতৃত্ব প্রদানের জন্য মেধা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে তার অতিরিক্ত আরো বেশি কিছুরও প্রয়োজন রয়েছে।
লি কুয়ান উই জানাচ্ছেন- ‘অচিরেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে নেতৃত্বের জন্য মেধার বাইরেও অনেক কিছুর আবশ্যকতা অপরিহার্য। একজন মেধাবি ব্যক্তি তার প্রজ্ঞা দিয়ে যত সহজে ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ করতে পারে, যত সহজে একটি পিএইচডি থিসিস লিখতে পারে তত সহজভাবে গণনেতৃত্বে সফলতা অর্জন করতে পারে না। জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আরো অনেক কিছু প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন সাহসিকতা, আত্মপ্রত্যয়, দায়বদ্ধতা, সুচরিত্র এবং সক্ষমতা।
যেসব গুণের কারণে জনগণ নেতার পদাঙ্ক অনুসরণে অনুপ্রাণিত হয় সেসব গুণের অধিকারী হওয়া একজন নেতার জন্য অতীব জরুরি। এজন্য আমাদের এমন লোকের প্রয়োজন ছিল যিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তৎপর, সুবিবেচক এবং মানুষের সাথে মেলামেশায় দক্ষ।’

মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতাও নেতৃত্বের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় গুণাবলী
১৯৭০ সালে আমেরিকার মহাকাশযান এপোলো-১৩ মহাকাশে যায়।এই ঘটনাপ্রবাহ তখন টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল। লি কুয়ান ইউ তা দেখছিলেন। তিনি দেখলেন, পৃথিবী থেকে তিন লক্ষ মাইল দূরে থাকা মহাকাশযানটি কার্যকরভাবে কাজ করছিলো না। নভোচারীদের একজন সামান্য ভুল করেছিল এবং এতে সকলে বিপদের মধ্যে পড়ে। কিন্তু মহাকাশযানে থাকা সবাই একটুও বিচলিত না হয়ে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষের নির্দেশনা অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পালন করে যাচ্ছিল। শেষে তারা বিপর্যয়ের কবল থেকে রক্ষা পায়। মহাকাশে প্রেরণের আগে আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা নভোচরাদিদের মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতারও পরীক্ষা গ্রহণ করতো।

লি কুয়ান ইউ এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে তার সরকারে যারা নিযুক্ত হতেন তাদের তিনি মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতার পরীক্ষার ব্যবস্থা করতেন। তিনি লিখেছেন- এ ঘটনা পর্যবেক্ষণের পর আমি আমাদের সকল পর্যায়ের প্রার্থীদের মানসিক সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য মনোবিজ্ঞানী এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম।

মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, বুদ্ধিমত্তা, মূল্যবোধ ও জীবনাচার ইত্যাদি সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখা হতো। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিশ্লেষণ ক্ষমতা, তার দূরদৃষ্টি ও বাস্তব-সম্পর্কিত জ্ঞান এই গুণাবলী বিষয়েও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় পর্যবেক্ষণ করা হতো।

নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজ
১৯৭৪ সালে কোনো একদিন তিনি অর্থমন্ত্রী সুই সেন-এর সাথে আলাপ করছিলেন। সুই সেন তার কাছে আশংকা প্রকাশ করছেন যে, তাকে সম্ভবত আগামী সাধারণ নির্বাচনের পরে সরে দাঁড়াতে হতে পারে। কারণ তার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। তখন পর্যন্ত সুই সেনের বয়স ছিল ৬৫ বছর। লি কুয়ান ইউ জানাচ্ছেন সুই সেনের সাথে সেদিনের আলোচনা তার উপর প্রচন্ড প্রভাব পড়েছিল। তারপর থেকে তিনি নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী নির্বাচনের দিকে নজর দিতে থাকেন।

এরপর তিনি বলছেন- ‘আমাদের চূড়ান্ত কাজ ছিল শক্তিশালী উত্তরাধিকার গড়ে তোলা। মাও সেতুং এ সমস্যা উত্তরণের নিমিত্ত যোগ্য উত্তরাধিকার বিকাশের স্বার্থে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ছত্রছায়ায় লং মার্চের ডাক দিয়েছিলেন। আ্মাদের পক্ষ থেকে এমনটা করা সম্ভব ছিল না। সঠিক চরিত্রের নেতৃত্বের মাধ্যমে আমাদেরকে সমাধানের পথ খুঁজতে হয়েছিল, যারা সংকট মোকাবেলার মধ্য দিয়েই পরীক্ষিত নেতা হিসেবে বিকশিত হবে।’

তিনি বলছেন- ’আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নেতৃত্বের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি না করে নতুন রক্তের সঞ্চালন করা। এ প্রক্রিয়াতে প্রতিষ্ঠাপন প্রাক্কালে আমার অনেক পুরাতন সহকর্মীকে নিজেদের পদ ছেড়ে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল।’

তিনি নিজেকে তখন থেকেই ‘বয়স্কদের কাতারে ধাবিত’ হচ্ছিলেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলছেন, নিজেকে প্রতিদিন আয়নাতে দেখে আমিও আমার অবস্থান বুঝতে পারতাম। আমাকে আমি আর আগের মতো সপ্রতিভ, ক্লান্তিহীন এবং উদ্দীপ্ত ভাবতে পারতাম না। তার চেয়েও বড় কথা, প্রকাশিত প্রতিবেদন, ছবি ও ভিডিও-র প্রতি আমি আস্থাশীল ছিলাম এবং বয়সের ব্যাপারটি বুঝতে পারতাম।

তবে এই সময়ে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার ধরণ বা কৌশল কী ধরণের হবে নিয়ে তিনি তার সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা বাধা বিপত্তিরও সম্মুখীন হচ্ছিলেন। তার পুরাতন বয়স্ক সহকর্মীরা নতুনদের জায়গা ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তারা যেভাবে ‘তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে উঠে এসেছেন’ সেভাবেই তাদের উত্তরসূরীদের উঠে আসা দরকার বলে মনে করতেন।

কেউ কেউ মনে করতেন নতুনদের এত সহজভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে দেয়াটা ঠিক হবে না, তাদের আরো শেখা উচিত ও অপেক্ষা করা উচিত।

কিন্তু লি কুয়ান ইউ ভিন্নমত পোষন করতেন এবং সেভাবে্ই তিনি সিঙ্গাপুর পরিচালনার জন্য পরবর্তী নেতৃত্বকে গড়ে তুলেছেন। দেশ থেকে ও বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনি নির্বাচিত করেছিলেন এবং তারা পার্টিতে যোগদানের তিন চার বছরের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি বলছেন- ‘… আমি মনে করতাম নতুন জমানার মেধাবী ছেলেদের অপেক্ষা করবার মতো অবকাশ নেই, পার্টিতে রাখতে হলে ওদেরকে যথাযথ সুযোগ করে দিতে হবে, অন্যথায় ওরা ওদের পছন্দের পথে চলে যাবে।’

এভাবে তিনি সিঙ্গাপুরের যোগ্য উত্তরসূরী প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে এক কথায় বলা যায় ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তবে উত্তরাধিকার নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি যোগ্যতর নেতৃত্ব খুঁজতেও কড়া ধরণের পরীক্ষণ নিরীক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
রাষ্ট্রীয় বা সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ধান্ধাবাজিতে অনভ্যস্ত মেধাবী, আন্তরিক, কর্মদক্ষ এবং গতিশীল তরুণ কর্মকর্তাদের উপর’ তিনি ও তাঁর সরকার আস্থা রেখেছিলেন।’(পৃঃ ১০৭)

তিনি আরো বলছেন- ‘… নবনিযুক্তদের জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা এবং তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের সাথে সম্পৃক্ততার গুণাগুণ অর্জন করাটা ছিল অত্যাবশ্যক। যাদের ভেতর এ সমস্ত অতিরিক্ত গুণাবলী পরিদৃষ্ট হত আমি শুধু তাদেরকেই মন্ত্রীসভায় স্থান করেদিতাম।’

তিনি নিজেও নতুনদের জন্য তার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি জানাচ্ছেন- ‘আমি ৩১ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলাম। ইচ্ছে করলে আরো এক টার্মের জন্য প্রধানমন্ত্রীত্বের পদে বহাল থাকতে পারতাম। কিন্তু তাতে আমার সক্ষমতা ও কার্যকারিতার প্রমাণ ব্যতিরেকে তেমন কিছুই অর্জিত হত না, অন্যদিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে আমি যদি আমার উত্তরসূরিদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারি তা হলে তা-ই হবে সিঙ্গাপুরের জন্য অধিকতর কল্যাণকর, এ ধরণের চিন্তাভাবনা থেকেই আমি আর প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ ধরে রাখিনি।’
১৯৯০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ ছেড়েছিলেন।তবে তারপরও তিনি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

লি কুয়ান ইউ’র ন্যায়সংগত সমাজ গঠনের কাজ
লি কুয়ান ইউ জানাচ্ছেন যে, তারা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সমঅংশীদারিত্ব ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক একটি সমাজ গড়াতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু অর্থনীতির বিকাশের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিকাশ ও প্রণোদনার প্রয়োজন ছিল। তবে তিনি বলছেন- ‘সকলের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতা সমান নয়, এক্ষেত্রে যদি কর্মদক্ষতার আলোকে বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাপ্যতা নির্ধারিত হয় তাহলে কেউবা অধিক লাভবান হবে, কেউ বা মাঝারী লাভবান হবে এবং ব্যাপক সংখ্যক লোক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এতে করে সামাজিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাধাপ্রাপ্ত হবে।’(পৃঃ ১৩৫)

লি কুয়ান ইউ তাই রাষ্ট্রের অর্জিত সম্পদ সমভাবে বন্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন- ‘আমরা যদি আমাদের অর্জিত সম্পদ ‍বিতরণে সমবন্টনের নীতি অনুসরণ না করতাম, তাহলে আমাদের জাতীয় সংহতির অনুভূতি দুর্বল হয়ে পড়ত এবং একটি সুনির্দিষ্ট অভীষ্টে চলার পথে হোঁচট খেত। আমি ব্যক্তি বিশেষের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে গোষ্ঠী সংহতির স্বার্থে তাওইজমের প্রতীক তথা দুটি মাছের মাধ্যমে একটি চক্রসদৃশ সমাজিক বন্ধন গড়ে তুলেছিলাম। এর একটি মাছ ছিল পুরুষসদৃশ এবং অন্যটি নারী। এক্ষেত্রে পরুষ মাছটি যদি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে সকল কিছু অর্জন করে নিত, তা হলে সামাজিক সংহতি দুর্বল হয়ে যেত, যে কারণে ভারসাম্য তথা সামাজিক সংহতি রক্ষার্থে আমরা নারী মাছটির অনুকূলেও সম্পদের অংশবিশেষ বিতরণ করেছিলাম।’ (পৃঃ ১৪৭)
লি কুয়ান ইউ’র নেতৃত্বের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে তাঁর রাজনৈতিক জীবনী পাঠ করা প্রয়োজনীয়। তিনি কিভাবে সমস্যার মীমাংসা করেছিলেন, কিভাবে তিনি বাস্তব পরিকল্পনা করেছিলেন এবং বাস্তব সমস্যাসমূহ বাস্তবে বাস্তবিকভাবে একে একে সমাধান করতে পেরেছিলেন এ বিষয়গুলো তার লিখিত বই বা তাকে নিয়ে লেখা বই থেকে জানা সম্ভব হবে। যারা নেতৃত্ব দিতে চান বা যারা সমাজের জন্য কিছু একটা করতে চান তারা লি কুয়ান ইউ’র এই নেতৃত্বের ধরণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবেন এই প্রত্যাশা থাকলো।

Tuesday, December 29, 2015

খাগড়াছড়ি পৌর নির্বাচনঃ একতা দেখাতে হেলে কিরণ মারমাকে ভোট দিন





একটু দেরিতে পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা বলতে  হচ্ছে। আরও আগে এ বিষয়ে কথা বলতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।
প্রথমে একটি সত্য উচ্চারণ করছি, তা হলো, তিন পার্বত্য জেলার মোট কয়টি পৌরসভায় নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা আমি এখনো জানি না। এটা আমার দুর্বলতা বলতে পারেন। এবং এটাই আমাদের সীমাবদ্ধতাও বলতে পারেন। জুম্ম জাতিসত্তার জনগণ হিসেবে এখন নিজেদের জায়গায়ও আমরা কতোটা কোণঠাসা তা জানা যাবে আমরা আমাদের এলাকা সমূহের খবরও আর রাখার প্রয়োজন বোধ করি না তা থেকে। আর জানার প্রয়োজনই বা কেন থাকবে!!?
সুতরাং, অন্য এলাকায় কেমন নির্বাচন হচ্ছে সে নিয়ে আর কথা বলবো না।
তবে নিজের এলাকা হিসেবে খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা না বললে বোধহয় ভুল হতে পারে।
খাগড়াছড়িতে এবারে মেয়র প্রার্থী রয়েছেন ৪ জন। তারা হলেন, কিরণ মারমা(নারিকেল গাছ), রফিকুল আলম(মোবাইল), শানে আলম(নৌকা) ও এছাড়া আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন লাঙল মার্কায়।

এবার আসি, আমরা বা আমি কোন প্রার্থীকে ভোট দিতে চাই তা নিয়ে।
কারো প্রতি বিদ্বেষ না করে আমাকে বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এবং প্রথম সংবিধান প্রণয়নের পর থেকেই এই দেশের সরকারসমূহ প্রতিনিয়তই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে শেখ মুজিবের নীতি অনযায়ী ‘দশলাখ, বিশলাখ’ দিয়ে পিষিয়ে সংখ্যালঘূকরণের চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে।
এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, জুম্ম জনগণের জন্য নিজেদের এলাকায় একটি শহর বা শহরাঞ্চল বা মফস্বল শহরও অবশিষ্ট রাখা হয়নি যেখানে জুম্মরা নিজেদের সংখ্যাধিক্য বজায় রাখতে পেরেছে। অথচ, একটি জাতি/জাতিসমূহ বা জাতিসত্তার জন্য পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার নিরিখে নগরসভ্যতার স্বাতন্ত্র্য স্বকীয়তাসম্পন্ন ঐক্যচেতনাবোধ সৃষ্টি হওয়া অতি অবশ্যই প্রয়োজনীয়। এদিক থেকে আমরা এতই বিস্রস্ত/অবিন্যস্ত যে, এ নিয়ে আমাদের ন্যূনতম চেতনা থাকলে গা শিউরে ওঠার কথা আমাদের সচেতনদের মধ্যে! কিন্তু খুবই বিড়ম্বের যে, আমরা গা শিউরে উঠতেও ভুলে গেছি!
বরং এখন যা দেখি তা হলো, যা আছে, বা যে একতা ঐক্য বা একতাবদ্ধতা অবশিষ্ট আছে তা ভাঙতেই যেন আমরা সোচ্চার থাকি সবসময়!

শুনলাম, এবারে খাগড়াছড়িতে পৌরসভা নির্বাচনে জেএসএস(সংস্কার) এর বন্ধুরা নাকি শানে আলমের নৌকাকে ভোট দিতে বলছেন। এ নিয়ে সম্ভবত, আমাদের আরো আগে বিতর্কে জড়ানো দরকার  ছিলো। কিন্তু খুবই লজ্জ্বা বিষয় ও ভীতসন্ত্রস্ত হবার মতো বিষয় হলো, আমাদের দল বা পার্টিসমূহ মনে করে তারাই সর্বেসর্বা বা তারা যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন তা-ই  ‘জাতির জন্য মঙ্গলজনক/কল্যাণকর!’এটা ইউপিডিএফ, জেএসএস ও জেএসএস(সংস্কার) এই তিন দলের ক্ষেত্রে অনেকসময় একই বলে প্রতীয়মান হয়।

তারা নিজেদের দোষ কোনোদিনই দেখেন না। তারা খোজেন অন্যের দোষ!
জানলাম খাগড়াছড়িতে জেএসএস(সংস্কার) দলটি শানে আলমকে ভোট দেবার জন্য নাকি বিভিন্ন জায়গায় প্রচারণা চালাচ্ছে। এবং এজন্য তাদের যুক্তি হলো-

১. কিরণ মারমা শক্তিশালি প্রার্থী নয়। তার দুর্বলতা রয়েছে।

২. তাকে ভোট দিলে নাকি ‘ভোট’টি পানিতে বা জলে ফেলার মতো হবে। অর্থা তাকে ভোট দিলেও তিনি জয়যুক্ত হবেন না! এটা হলো, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার আগেই পরজায় স্বীকার করা!

৩. তারা আরো যুক্তি দেখিয়েছেন যে, কিরণ মারমাকে যখন প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে তখন নাকি তাদের সাথে মানে জেএসএস-সংস্কার দলের সাথে আলাপ করা হয়নি বা পরামর্শ করা হয়নি।

৪. তারা আরো বলেছেন ‘রফিকুল আলম’কে ঠেকাতে শানে আলমকে ভোট দিতে হবে!

৫. তারা নাকি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, তারা চুক্তি করেছেন আওয়ামীলীগের সাথে। সুতরাং তাদের সাথে নাকি ঐক্য থাকা দরকার!
এছাড়া সম্ভবত অন্য যুক্তিও তারা দেখাতে পারেন।

এ বিষয়ে কিছু বলা দরকার বলে মনে করছি-

১. কিরণ মারমাকে যদি আমরা ব্যক্তি হিসেবে ধরি তবে তার নানা দুর্বলতা আমরা দেখাতেই পারবো! সম্ভবত আমরা এই পোড়ার ভুমিতে ‘অবিসংবাদিত’ কাউকেই পাবো না! একমাত্র এম এন লারমা মারা যাবার পরেই এই অভিধা্ পেয়েছিলেন। তিনি জীবিত থাকতে তা পাননি। এবং এখনো বলা হয়ে থাকে তিনি তার ভাইকে ভালবেসেছেন বেশি।তাই এ ক্ষেত্রে তিনি বিতর্কের উর্দ্ধে উঠতে পারেননি।
সুতরাং, কিরণ মারমাকেও অনেকেই পছ্ন্দ করবেন না বা তার নানা দুর্বলতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তাই বলে, একতা বা ঐক্যবদ্ধতাকে আমরা যখন প্রদর্শন করবো বা করতে পারবো তখন এই সকল বক্তব্য এনে কিই বা হবে ক্ষতি ছাড়া!
২. বলা হচ্ছে সংস্কার দলের সাথে পরামর্শ করা হয়নি। হ্যাঁ, এটা ঠিক হতে পারে বা হবে বলেই তো মনেহয়। কিন্তু তাই বলে ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা’ কি ঠিক বলে মনেহয়?
নিজে একটি দলের কর্মী হয়েও এখন আমার তিনদলকে এদিক থেকে একই কাতারে মাপতে সাধ জাগে।
এই তিন দলের বিরাট এবং মারাত্মক দুর্বলতা হলো এটাই। আর এই দুর্বলতা যদি তারা কাটাতে চেষ্টা না করে চাঙমা কথা কড়া ভাষায় বলবো ‘অধিকার পেবাত্তেই আঃ গুরি বাচ্চেই থিও’(কথাটি একটু কড়া হলেও সত্য বলার স্বার্থে বলতে বাধ্য হলাম।এখানে বলা দরকার নিজের পার্টির অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি একমত নই বা বর্তমান কাজের ধরণ নিয়ে আমার সমালোচনা রয়েছে; কিন্তু তাই বলে তো আমরা ‘নিজঅ থেঙঅত হুরোল’ মারতে পারি না।

সবার পক্ষ থেকে অনুরোধ জানাবো এই নির্বোধ আহাম্মকী বা আত্মম্ভরিতা ঝেড়ে ফেলতে। তারা সন্তু লারমাকে বলেন তিনি নাকি হাঁটার সময় আঙুলে হোঁচট খেলে পুনরায় যেখানে হোঁচট খেয়েছেন সেখানে আবার লাথি মারেন। কিন্তু এদের স্বভাবও যে একই তা সম্ভবত তারা জানেন না! নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার পণ যেন!
এই যদি কিরণ মারমাকে ভোট না দেয়ার কারণ হয়ে থাকে তবে বলবো, অধিকার আদায়ের জন্য আপনারা এই সামান্য স্বার্থও যখন ছাড়তে পারছেন না তখন আপনাদের দ্বারা অধিকার আদায় অসম্ভব।
এখানে বলা দরকার, আমি নিজে পার্টির অনেক কিছু মানতে নাও পারি এবং এটাই সত্য যে মানি না। তাই বলে তা নিয়ে নিজের দলকে আমি ভুলে গিয়ে অন্য দলে যোগ দেবো, এটা চিন্তা করা মানে তো সংঘভেদের নামান্তর! নিজের বা নিজেদের প্রার্থীকে সমর্থন না দিয়ে অন্য দলের প্রার্থীকে সমর্থন দেয়া তো সংঘভেদেরই নামান্তর! আর সংঘভেদের ফল? এখানে সংঘভেদ মানে পার্টিভেদ নয়, তা হলো জাতিভেদ।

৩. আমরা ভোট পাবো বিজয়ী এজন্যই লড়ছি। হ্যাঁ, যদি নাও পাই তবে আমরা যে ঐক্যবদ্ধ তা অন্তত আমরা দেখাতে পারবো। আর এটাকেই বলা হয় বিজয়। এই বিজয় নিয়ে যারা চিন্তিত নয় তারা কী জন্যে সংগঠন করে বা কী কারণে জাতির বা জাতিসত্তার জন্য কথা বলবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান। এ নিয়ে আমি আরো কড়া কথা বলতাম কিন্তু বললাম না।

৪. রফিকুল আলমকে ঠেকাতে?!!! রফিকুল কে? তার পেছনে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র না থাকলে তিনি কে?

৫. আওয়ামীলীগের সাথে জোটবাঁধা? যে বাঙালি বানিয়েছে তার সাথে? যে চুক্তি করে আধাবগা বানিয়েছে তার সাথে?

আমি আর কথা বাড়াবো না।

খাগড়াছড়িতে নির্বাচনে কিরণ মারমার পক্ষে তেমন প্রচারণা চালাতে না পারলেও আমার পক্ষ থেকে অনুরোধ থাকবে সকলের প্রতি-

## আমি জুনি থ্যাঙঅন্দি ঘাদা হেবার ন চেই আমি জুনি নিজঅর একতা দেঘেবার চেই তোইলে এক ওইনেই আমাত্তুন কিরন মারমারেই ভোট দিআ পুরিবঅ।

### আমি জুনি বেজা জেবার ন চেই তোইলে কিরণ মারমারেই ভোট দিআ পুরিবঅ।

#### আমি জুনি জাদঅরে কোচ পেই এবং সত্যিকারভাবে দলঅরে বা কোচ পেই তোইলে আমাত্তুন কিরণ মারমারেই ভোট দিআ পুরিবঅ।
##### আমাত্তুন জুনি এক্কেনাও্ লাজ থায় তোইলে আমাত্তুন কিরণ মারমাকে ভোট দিআ পুরিবঅ।

###### আমি আহামম্মকী বা উহজোধী ছাড়িবার চ্যালে বা নিজর ক্ষতি সামান্য ওইনেইও জাদঅর ডাঙর ভালেদি বিরাট গুরি দেঘি তোইলে আমাত্তুন কিরণ মারমাকে ভোট দিআ পুরিবঅ।

সবাইকে ধন্যবাদ

Saturday, December 12, 2015

ঢাকায় তিন সংগঠনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে প্রদত্ত বক্তব্য

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সংগঠন ঢাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা পাদদেশে। সেখানে তিন সংগঠনের(পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম) নেতৃবৃন্দ ছাড়াও জাতীয় ছাত্র-নারী ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। উক্ত সমাবেশে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)এর প্রতিনিধি হিসেবে আমি বক্তব্য প্রদান করি। বহুদিন পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দিলাম। যখন ছাত্র সংগঠনে ছিলাম তখন মাঝে মাঝে মিছিল সমাবেশ হলে বক্তব্য দিতে হতো। এছাড়া মিছিলে শ্লোগান ধরতাম তখন। এরপর অনেকদিন অনিয়মিত ছিলাম মিছিল ও সমাবেশে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিক্ষোভে আমি যা বক্তব্য দিয়েছি তা সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরতে ইচ্ছে হলো।
এক.
আলোচনায় বলি, অপারেশন উত্তরণ জারির মাধ্যমে এবং সবশেষে গত জানুয়ারি মাসে ১১ দফা নির্দেশনা জারির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের অন্য অঞ্চলের চেয়ে আলাদা শাসনব্যবস্থা জারি করা হয়েছে। সংবিধানে  এককেন্দ্রীক শাসনব্যবস্থার বৈধতা রয়েছে। কিন্তু দেশের অন্য অঞ্চলে গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু রাখা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে চালু রাখা হয়েছে ভিন্ন শাসন ব্যবস্থা। একদেশে দুই ধরণের শাসনব্যবস্থা চলতে পারে না।  পুরো দেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করতে দাবি জানাই এবং সভা সমাবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে বলে বক্তব্য দিই।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি সীমিত মাত্রায় হলেও সেনাশাসন চালানো হয় তবে তার প্রভাব একসময় না এক সময় দেশেও পড়বে বলে মন্তব্য করি। আমি বলি, দেশে দেখা গেছে কয়েকবছর ব্যবধানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বদলে সেনা নিয়ন্ত্রিত বা সেনা পরিচালিত শাসন কায়েম হয়। তার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন চালু থাকার কারণে সেখান থেকে পরে তার বিস্তৃতি দেশেও ছড়িয়ে যায়। সুতরাং, গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দাবিদার সংগঠন ব্যক্তিগণ যদি শুধু দেশের প্রেক্ষিতে কথা বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে বাদ দিয়ে ‘গণতন্ত্র’ ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ ইত্যাদির কথা বলে থাকেন তবে তাতে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এছাড়া বলি, অনেকেই পার্বত্য সমস্যাকে শুধুমাত্র পার্বত্য জনগণের সমস্যা হিসেবে দেখে এ বিষয়ে সোচ্চার থাকে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে দেশের সচেতন সজাগ প্রগতিশীল দাবিদার ও বিপ্লবী সংগ্রামী সংগঠন ব্যক্তিকে আরো সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করি।
দুই.
সাধারণত আমরা জানি রাষ্ট্রীয় নীতি পদ্ধতি বা রাষ্ট্রের পরিচালনা পদ্ধতি কী ধরণের হবে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংহতি কী ধরণের হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভাবে  নির্বাচিত সরকারই ঠিক করে দিয়ে থাকে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে কী ধরণের শাসন চলবে, সেখানে সেনাশাসন চলবে নাকি চলবে না, সেখানে কার উপর নিপীড়ন চালানো হবে তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কোনো কর্মকর্তা প্রকাশ্যে পত্রিকায় মিডিয়ায় মত প্রকাশ করতে পারেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করি। আমি বলি, যদি তারা দেশের একটি অঞ্চলের বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করতে প্রকাশ্যে মত দিয়ে থাকেন বা করে থাকেন তবে দেশে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীমন্ডলী তথা সরকার গঠনের কীইবা প্রয়োজন রয়েছে?
তিন.
আমি বক্তব্যে বলি, এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে  ‘দেশপ্রেম’ ‘দেশপ্রেমিক’ এই শব্দগুলো খুব বেশি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রকৃতই দেশকে ভালবাসলে দেশের বর্তমান অবস্থা তো আরো ভালো হবার কথা ছিলো। আমি বলি, অপরাজেয় বাংলা এই ভাস্কর্যটিতে তিনজনের মূর্তি রয়েছে। এরাই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামীদের প্রতীক। তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে দেশের মুক্তি এনেছেন। কিন্তু প্রকৃতই নিজেদের স্বার্থ ছেড়ে দিয়ে কেইবা দেশকে ভালবেসেছে? দেশপ্রেম মানে হলো নিজেদের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকার পাশাপাশি অন্যের অধিকারের প্রতি মর্যাদা দেয়া, অন্যের অধিকার রক্ষার প্রতি সচেষ্ট থাকা। দেশপ্রেম মানে হলো, অন্যদেরকে মর্যাদা দেয়া।
কিন্তু আমরা দেখি এই সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয়ার নামে তলে তলে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়ত জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে চেষ্টায় থাকে। তারা সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এরই মাঝে জুম্ম জনগণকে সংখ্যালঘু করার পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
যে অন্যায় আমাদের উপর করা হচ্ছে তা দ্বিগুণ হয়ে দেশের জনগণের উপর চেপে বসছে এবং তার জন্য দেশে জঙ্গী সাম্প্রদায়িকতাবাদ অশান্তি তীব্রতর হচ্ছে বলে মন্তব্য করি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার বিষয়ে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মত প্রকাশ করি।
মূলত, উপরের এই সকল বিষয়েই আমি বক্তব্য প্রদান করি।
বক্তব্য লিখে ব্লগে প্রকাশ করার মানে হলো, বক্তব্য বিষয়ে আরো দায়িত্বশীল হবার চেষ্টা করা।
যা বলা প্রয়োজন তা যতই তেতো হোক তা সোজাসুজি করে বলা দরকার বলে আমার মত।
তাই এই লেখা লিখলাম।
যদি বক্তব্য বিষয়ে কোনো সমালোচনা বা আপত্তি থাকে তা জানালো খুশি হবো।
ধন্যবাদ

Saturday, December 5, 2015

বিশ্বনাগরিক ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস

প্রতিটি সত্যিকার বিপ্লবই সামাজিক বিপ্লব, কারণ সে নতুন একটি শ্রেনীকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে আর সেই শ্রেনীকে তার নিজের ধাঁচে সমাজকে পুনর্গঠিত করার সুযোগ দেয়- ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। জার্মান লেখক, দার্শনিক, রাজনৈতিক বিষয়ে তাত্ত্বিক লেখক।সর্বোপরি তিনি এবং কার্ল মার্কস ছিলেন কীর্তিমান দুইজন বন্ধু, যাদের হাত ধরে জন্ম নিয়েছে সর্বহারা তথা দুনিয়ার তাবৎ শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির/সংগ্রামের দর্শন দ্বন্দ্বমূলক ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা মার্কসবাদ। এঙ্গেলসের জন্ম নভেম্বর, ১৮২০ প্রুশিয়া’র রাইন প্রদেশের বারমেন অঞ্চলে। প্রুশিয়ার এই এলাকা বর্তমানে জার্মানীর অধীনে ভুপারতেল নামে পরিচিত।এঙ্গেলসের মৃত্যু হয় ৭৪ বছর বয়সে ১৮৯৫ সালের ০৫ আগস্ট লন্ডনে। তার পিতার নাম এঙ্গেলস সিনিয়র।ছিলেন বারমেনের টেক্সটাইল শিল্পকারখানার একজন মালিক।
বারমেনে বা ব্রেমেনের জীবন
তার পিতার পিড়াপীড়ির কারণে এঙ্গেলস ১৭ বছর বয়সে স্কুলের লেখাপড়া ছেড়ে দেন। এঙ্গেলসের পিতা চেয়েছিলেন তার ছেলে যেন ব্যবসায়ী হয়।তাই তার ছেলেকে তিনি হাতেকলমে ব্যবসার কাজ শেখাতে উদ্যোগ নিলেন। ১৮৩৮ সালে তার বাবা বারমেনের বা ব্রেমেনে একটি কারখানায় তাকে কেরানী হিসেবে কাজ করতে পাঠান। তার বাবা আশা করেছিলেন তার ছেলে তার পিতার পেশা বেছে নেবে। কিন্তু এঙ্গেলস বাবার পারিবারিক ব্যবসায় না জড়িয়ে বারমেনে হেগেল নামে দার্শনিকের লেখা পড়া শুরু করলেন।সেখানে তিনি ব্রিটিশ, পোরতুগীজ, ফরাসী ও বিভিন্ন ভাষার পত্রপত্রিকা পড়ার সুযোগলাভ করেন। এতে তার চিন্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিতে লাগলো।তিনি সমাজ শ্রেনী শ্রমিকদের দুরাবস্থা বিষয়ে সংবেদনশীল হয়ে উঠতে শুরু করলেন। তার পিতা ছেলের ‘অধপতন’এ চিন্তিত হয়ে তাকে এক পাস্টরের কাছে ধর্মীয় শিক্ষালাভের জন্য রেখে দিলেন। কিন্তু সেখানে তিনি ধীরে ধীরে ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। ‘ডেভিড স্ট্রাউস’ নামে একজনে লেখকের ‘যীশুর জীবন’ বইটি পড়ার পরে তার মনে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন আরো ঘনিভূত হলো। তিনি খ্রিস্টধর্মের জোয়াল থেকে মুক্ত হতে শুরু করলেন।
এ সময়ে তিনি কবিতাও লিখতে শুরু করেন; কিন্তু তাতে তিনি তেমন সুবিধে করতে পারেননি।ফ্রেডরিখ অসওয়াল্ড নামে ছদ্মনামে তিনি এ সময় কিছু লেখালেখি করেন।কলেকারখানায় শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে তিনি শিল্পায়নের সামাজিক ব্যাধি নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। ‘জার্মান টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় তিনি ‘ভুপারতেলের পত্র’ নামে প্রবন্ধ লেখেন। এতে তিনি শ্রমিকশ্রেনীর উপর শোষনের বিরুদ্ধে, জমিদার শ্রেনীর সেচ্ছাচারিতা ও সামন্ততান্ত্রিক ভুমি মালিকানার বিরুদ্ধে কথা বলেন।
বারমেনে তিনি তিনবছর ছিলেন।

সৈন্যবাহিনীতে কিছুদিন
১৮৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি প্রুশিয়ান পদাতিক গোলন্দাজ বাহিনীতে তিনি সাধারণ সৈন্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। এই সময় তিনি সমরবিদ্যায়ও পড়াশুনা করতে থাকেন। পরে তিনি সৈন্য হিসেবে বার্লিনে বদলী হন। সেখানে তিনি ইয়াং হেগেলিয়ান নামে এক গ্রুপের সাথে যুক্ত হন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তিনি বিভিন্ন অধ্যাপকের বক্তৃতা শুনতে যেতেন।বার্লিনে থাকার সময় দার্শনিক ফয়েরবাখের ‘খ্রিস্ট ধর্মের সারকথা’ পড়ে আরো বেশিকরে বস্তুবাদী হয়ে ওঠেন।
১৮৪২ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।

ইংল্যান্ডের শিল্পশহর ম্যানচেস্টারে এঙ্গেলস
১৮৪২ সালে এঙ্গলসের পিতা এঙ্গেলসকে ইংল্যান্ডের শিল্প এলাকা ম্যানচেস্টারে পাঠান।তার পিতা চেয়েছিলেন তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘আরমেন এন্ড এঙ্গেলস’ বস্ত্রকলের অফিসে ব্যবসা বাণিজ্য ও প্রশাসন বিষয়ে এঙ্গেলস হাতেকলমে শিক্ষালাভ করবেন।কিন্তু এঙ্গেলস তার বাবার কারখানায় কাজ করলেন বটে, তবে তিনি তার চেয়ে আরো বেশি যা করলেন তা হলো, তিনি ম্যানচেস্টারের শ্রমিকদের দুরবস্থা নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে শুরু করলেন।পরে এই অভিজ্ঞতা থেকে ও তার সংগৃহীত তথ্য নিয়ে পরবর্তিতে তিনি প্রকাশ করেন ‘দ্য কনডিশন অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’ নামে একটি বই।ম্যনেচেস্টারে থাকার সময় তিনি চার্টিস্ট আন্দোলনের সাথে যোগ দেন। তিনি চার্টিস্টদের পত্রিকা নর্দার্ন স্টার ও রবার্ট ওয়েনের নিউ মরাল ওয়ার্ল্ড নামে দুটি পত্রিকায় নিয়মিত কাজ করতে শুরু করলেন।এঙ্গেলসম ম্যানচেস্টারে দুই বছর কাটান।
এই সময়েই তিনি কার্ল মার্কস কর্তৃক সম্পাদিত রাইনিশচে চাইটুং নামক পত্রিকায় ছদ্মনামে শ্রমিকদের দুরাবস্থা নিয়ে লেখালেখি করেন। উক্ত পত্রিকায় তিনি The English View of the Internal Crisis, The Position of the Political Parties, The Corn Laws, Outlines of a Critique of Political Economy ইত্যাদি প্রবন্ধ রচনা করেন।

দুই কীর্তিমান বন্ধুর দেখা
১৮৪৪ সালে এঙ্গেলস ম্যানচেস্টার থেকে প্যারিস হয়ে জার্মানীতে ফিরলেন। ফেরার আগে তিনি প্যারিসে কার্ল মার্কসের সাথে দেখা করলেন।দেখা হবার আগেও তাদের সাথে পত্রালাপ ছিলো।১৮৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের মধ্যে সাক্ষাত হয়(ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস-এলিওনর মার্কস এভেলিং)।তবে পল লাফার্গ ১৯০৫ সালে লেখা ‘এঙ্গেলস স্মৃতি’ নামক একটি লেখায় লিখেছেন, ‘১৮৪২ সালের নভেম্বরের শেষাশেষি রাইনিশচে চাইটুং সম্পাদকীয় দপ্তরে এঙ্গেলস আসার ফলে মার্কস ও এঙ্গেলস প্রথম পরষ্পরের পরিচিত হন’। তবে প্রথম সাক্ষাতটি সাধারণ সৈজন্যমূলক সাক্ষাত ছিলো বলে মনেহয়।
দেখা হবার পরে এই দুই কীর্তিমান ব্যক্তি পরষ্পরের এমন বন্ধু হয়ে গেলেন যে, আজও এই দুই কীর্তিমানের বন্ধুত্ব সবার মাঝে সমীহ জাগায়, বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।তাদের এই বন্ধুত্ব ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক।দুইজন পরিচিত হবার পরে তাদের সকল কীর্তি যেন আর একজনের থাকলো না! তারা যা-ই করেন তাতেই দু’জনের প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটতে থাকলো।

হলি ফ্যামিলি’র ভ্রান্ত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে
১৮৪৪ সালে প্যারিসে মার্কস ও এঙ্গেলসের দেখাসাক্ষাত হলে মার্কস প্রস্তাব করে তারা দু’জনে নব্য হেগেল অনুসারী বা হেগেলিয়ানদের নেতা ব্রুনো বাউয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের লেখামূহকে বা হেগেল সংক্রান্ত তাদের ব্যাখ্যাকে খন্ডন করে একটি বই প্রকাশ করবেন। সে অনুযায়ী তারা একসাথে লেখেন ‘হলি ফ্যামিলি’। বইটির মূল নাম হলো- দ্য হলি ফ্যামিলি অর ক্রিটিক অব ক্রিটিক্যাল ক্রিটিসিজম এগেইনস্ট ব্রুনো বাউয়ের এন্ড কোম্পানী’। ব্রুনো বাউয়েরের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি তৎকালীন সময়ে ব্যাপকভাবে একাডেমিক লেভেলে প্রভাব বিস্তার করেছিল। বাউরের এই ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি জার্মান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার কারণে মার্কস ও এঙ্গেলস একসাথে এই বইটি রচনা করতে উদ্যোগী হন।
বইটি সম্পর্কে লেনিন এঙ্গেলসকে স্মরণ করে লেখায় লিখেছেন- “দার্শনিক বাউয়ের ভ্রাতা ও্ তাদের অনুগামীদের ঠাট্টাচ্ছলে করে বলা হয় ‘পবিত্র পরিবার’। উক্ত ভদ্রলোকগণ এমন সব সমালোচনার প্রচার করতেন, যার অবস্থান ছিলো বাস্তবতার উর্দ্ধে, যা ছিলো পার্টি ও রাজনীতির উর্দ্ধে, যা সমস্ত ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপ প্রত্যাখ্যান করে থাকে, যা পারিপার্শ্বিক জগত ও তার চারপাশের ঘটনাবলী নিয়ে কেবলমাত্র ‘খুঁতসন্ধানকারী’ হিসেবে অনুধ্যানে ব্যাপৃত থাকত। উক্ত ভদ্রলোকগণ, বাউয়ের ভ্রাতৃদ্বয়গণ, শ্রমিকশ্রেনীকে বুদ্ধিবিবর্জিত জনতা হিসেবে উন্নাসিকতার চোখে দেখে থাকে। মার্কস ও এঙ্গেলস নিরন্তর এই উদ্ভট ও ক্ষতিকারক প্রবণতার বিরোধিতা করেছেন।”
বইটি বিষয়ে তৎকালীন সময়ে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় লেখা হয়- বইটি’র ‘প্রতিটি লাইনে … রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, চার্চ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, পরিবারের বিরুদ্ধে, ন্যায়িকতার বিরুদ্ধে, ধর্মের বিরুদ্ধে এবং সম্পত্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ/বিদ্রোহ ঘোষনা করা হয়েছে’।

বারমেন থেকে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস
১৮৪৪ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে এঙ্গেলস প্যারিস থেকে জার্মানীর বারমেনে চলে আসেন। জার্মানীতে তিনি সমাজতন্ত্রীদের সাথে যোগাযোগ করার উদ্যোগ নেন। এসময় পরিবারের মধ্যে বুর্জোয়া আচার সর্বস্ব নিয়ম পালন করতে করতে এঙ্গেলসের মন বিষিয়ে ওঠে। তিনি সেখান থেকে চলে যেতে মরীয় হয়ে ওঠেন।
১৮৪৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী মাসে মার্কস প্যারিস থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্রাসেলসে চলে যেতে বাধ্য হন।জার্মানীর সাইলেসীয় তাঁতীদের অভ্যুত্থানের সমর্থনে লেখালেখি করায় প্রুশীয় সরকারের অনুরোধে ফ্রান্স মার্কসকে বিতাড়ন করে। এঙ্গেলস ওই বছরেরই এপ্রিল মাসে মার্কসের সাথে দেখা করতে ব্রাসেলসে যান।

দ্য কনডিশন অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস
ইংল্যান্ডে থাকার সময় এঙ্গেলস সে দেশের শ্রমিক শ্রেনীর অবস্থা নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনসহ নানা তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। পরে বারমেনে থাকার সময় তার সংগৃহীত তথ্যাদি নিয়ে তিনি ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যে এ বিষয়ে তার রচনার কাজ শেষ করেন এবং বই হিসেবে তা প্রকাশ করেন। উক্ত বইয়ে তিনি শ্রমিকশ্রেনীর জীবনসংগ্রামের চিত্র ও পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার শোষনমূলক চরিত্র তুলে ধরেন। বইয়ে তিনি ইংল্যান্ডের শাসক কে এই প্রশ্ন তুলে আনেন এবং জবাবে বলেন যে ইংল্যান্ডের মূল শাসক হলো পুঁজিপতি বা মালিকশ্রেনী।

অধ্যয়নের জন্য ও বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে ইংল্যান্ডে গমন
মার্কস ও এঙ্গেলস আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপক ও শ্রমিক আন্দোলনকে বুঝতে হলে ইংল্যান্ডে যাওয়া দরকার। তারা ইংল্যান্ডে গেলেন। ম্যানচেস্টারে তারা ১২ জুলাই থেকে ২১ আগস্ট, ১৮৪৫ ইং মোট ৬ সপ্তাহ কাটালেন। সেখানে থাকার সময় তারা চার্টিস্ট আন্দোলনের মিছিল মিটিঙে যেতে থাকলেন। এখানে তারা ‘লীগ অব জাস্ট বা ন্যায়নিষ্ঠদের লীগ’ সংগঠনের নেতাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পান এবং সুসম্পর্ক স্থাপন করেন।
বাকি সময় তারা ম্যানচেস্টারের চেথাম লাইব্রেরীতে রাজনীতি অর্থনীতি বিষয়ে লেখাপড়া করতে থাকলেন।
এরপর তারা আবার ব্রাসেলসে চলে আসলেন।
এবার এঙ্গেলসের সাথে তার বান্ধবী মেরী বার্নস সঙ্গে আসলেন। তার স্ত্রী ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভুত।

দুই বন্ধুর জ্ঞানের যৌথ ফসল জার্মান ভাবাদর্শ
এতদিন ধরে তারা যেসকল তথ্য ও মাল মসলা সংগ্রহ করেছিলেন তা নিয়ে তারা দীর্ঘ পরিশ্রম করে নতুন একটি বই লেখার পরিকল্পনা করলেন। প্রায় ছয়মাস কঠোর পরিশ্রমের পরে ৩০০ পৃষ্ঠার বইটি লিখলেন। বইটির নাম জার্মান ভাবাদর্শ-আধুনিক জার্মান দর্শনের সমালোচনা। ১৯৪৬ সালের মে মাসের মধ্যে বইটি লেখা হয়ে যায়।
বইটিতে বিভিন্ন আলোচনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্পর্কই সমাজের রূপান্তর তথা সামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাসের ঐতিহাসিক ভিত্তি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে সামনে আনলেন।
বইটিতে ইউরোপীয় ইতিহাস নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বলা হয়েছে বিভিন্ন শ্রেনীসমূহের মধ্যে পারষ্পরিক সংগ্রামই হলো মূলত ইউরোপের ইতিহাস।
বইটি সম্পর্কে মার্কস লেখেন, ‘আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো- ব্যাপার-স্যাপার নিজেদের মধ্যে স্পষ্টীকরণ এবং আমাদের সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল।’
বলতে গেলে তাদের এই যৌথ রচনার মাধ্যমেই তারা প্রথম তাদের দু’জনের রাজনৈতিক দর্শন ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করেন এবং পরে আমরা দেখবো তারা তাদের এই ‘ব্যাপার স্যাপার’ আরো বেশি গভীরভাবে ও বস্তুগতভাবে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করার কাজে ক্রমশ এগিয়ে গেছেন তাদের সারাজীবন ধরে।
উক্ত বইয়ে তারা এই দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, চৈতন্য জীবনকে নির্ধারণ করে না, বরং জীবনই নির্ধারণ করে চৈতন্যকে। তারা দেখান যে, মূলত, সমাজের উৎপাদন পদ্ধতির উপরই নির্ভর করে সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রকৃতি। আর এই সম্পর্কসমূহই নির্ধারণ করে দর্শন, নৈতিকতা, ধর্ম ইত্যাদি চেতনাগত বিষয়।
বইটি তারা নিজেদের জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে পারেননি। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে।

কমিউনিস্ট করেসপপন্ডিং কমিটি
১৮৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কস ও এঙ্গেলস সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করলেন কমিউনিস্ট করেসপন্ডিং কমিটি। ইউরোপের বিভিন্ন সমাজতন্ত্রী সংগঠনের সাথে যোগাযোগের জন্য মূলত এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করা হয়। দুই বন্ধু এই সংগঠনের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন কমিউনিস্ট সমাজতন্ত্রী গ্রুপের সাথে যোগযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। তারা দু’জনে মিলে একইসাথে কমিউনিস্ট আন্দোলনে তত্ত্বগত ভ্রান্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করলেন।
ইউরোপে এই সময় পেটি বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিক ও ইউটোপীয় সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের প্রাধান্য লাভ করেছিল। এই সময় জার্মানীতে ভিলহেলম ভাইটলিং ও ফ্রান্সে প্রুঁধোর স্থুল ও পেটিবুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক প্রভাব ছিলো।

লীগ অব জাস্ট থেকে কমিউনিস্ট লীগ
লীগ অব জাস্ট বা ন্যায়নিষ্ঠদের লীগ বা দল ‘অর্ধেক প্রচারমূলকভাবে ও অর্ধেক ষড়যন্ত্রমুলকভাবে কাজ চালাতো’(শেখর দত্ত;পৃ: ২৪)।সংগঠনটি ১৮৩৮ সালে ফ্রান্সে গঠিত হয়। এই সংগঠন সরকারকে উচ্ছেদ করে সমতাবাদী সমাজ গঠনের জন্য কাজ করতো। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানী, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই সংগঠনের কাজ ছিলো।
১৮৪৭ সালের দিকে লীগ অব জাস্টের নেতৃবৃন্দ মার্কস ও এঙ্গেলসদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সংগঠনে যোগদানের আহ্বান জানান। লীগ অব জাস্টের নেতৃবৃন্দ তাদের রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ভ্রান্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। তারা ক্রমে মার্ক ও এঙ্গেলসের দার্শনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিলেন।
১৯৪৭ সালের জুন মাসে লন্ডনে লীগ অব জাস্ট এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়।এঙ্গেলস উক্ত কংগ্রেসে প্যারিস অঞ্চলের প্রতিনিধ হয়ে যোগদান করেন।তাদের দুইজনের প্রস্তাবক্রমে সংগঠনের নাম বদল করে কমিউনিস্ট লীগ নাম রাখা হয়।ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব গ্রন্থে হায়দার আকবর খান রনো লিখেছেন,“শুধু নাম পরিবর্তনই নয়, সংগঠণের লক্ষ্য, চরিত্র সবকিছুই পরিবর্তিত হয়, নতুন নিয়মাবলী তৈরী হয়, যা রচনার ক্ষেত্রে প্রধান ভুমিকা নিয়েছিলেন ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। বস্তত এক নতুন বিপ্লবী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংগঠনে রূপান্তরিত হল।”-পৃ: ১২০
সংগঠনের শ্লোগান হিসেবে গ্রহণ করা হয় ‘Working Men of All Countries, Unite’(সকল দেশের শ্রমিক জনগণ, এক হোন!) এই শ্লোগানটি। সংগঠনের আগের শ্লোগান ছিলো- ‘সকল মানুষ ভাই ভাই’।
কংগ্রেস শেষ হবার পরপরই এঙ্গেলস ১৮৪৭ সালের ০৯ জুন তারিখে Draft of a Communist Confession of Faith নামে প্রশ্নোত্তরের একটি লেখা রচনা করেন। উক্ত লেখায় তিনি ২২ টি প্রশ্ন ও তার উত্তর সংক্ষিপ্তভাবে প্রদানের মাধ্যমে কমিউনিস্ট লীগের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করেন।
এই কংগ্রেসে ২য় কংগ্রেস ১৮৪৭ সালের ডিসেম্বরে করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া মার্কস ও এঙ্গেলসকে আগামী কংগ্রেসের সদস্য করার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। কংগ্রেসে কমিউনিস্ট করেসপন্ডিং কমিটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৮৪৭ সালে ২৯ নভেম্বরে লন্ডনস্থ রেড লায়ন হোটেলে কমিউনিস্ট লীগের দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এঙ্গেলসের সাথে মার্কস ব্রাসেলেসের প্রতিনিধি হিসেবে উক্ত কংগ্রেসে যোগ দেন। এই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিল ইউরোপের সাচ্চা সংগ্রামীদের প্রতিনিধিরা। কংগ্রেস চলতো সন্ধ্যায়। প্রতিনিধিদের অনেককেই তাদের দিনের ভরণপোষনের জন্য সারাদিন নানাকাজে ব্যস্ত থাকতে হতো। ঠিক এমনি দুরবস্থার মধ্যেও কংগ্রেসে সংগঠনের কর্মসূচি ও গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা হতে লাগলো। এঙ্গেলস Principle of Communism নামে একটি প্রস্তাবনা উক্ত কংগ্রেসে পেশ করেন।দীর্ঘ কয়েকদিন আলোচনা ও বিতর্কের পরে অবশেষে ০৮ ডিসেম্বর, ১৮৪৭ ইং কংগ্রেস উক্ত প্রস্তাবনা অনুমোদন করে। তবে কংগ্রেস থেকে সিদ্ধান্ত এই নেয়া হলো যে, মার্কস ও এঙ্গেলস একটি পূর্ণাঙ্গ মেনিফেস্টো বা ইশতেহার প্রস্তুত করবেন।
কংগ্রেস থেকে কার্ল শাপারকে চেয়ারম্যান ও এঙ্গেলসকে সম্পাদক ঘোষনা করা হয়।

কমিউনিস্ট ইশতেহার রচনা
কংগ্রেস থেকে মার্কস ও এঙ্গেলস ব্রাসেলসে আসেলেন। কিছুদিনের মধ্যে এঙ্গেলস সাংগঠনিক কাজের জন্য প্যারিসে চলে গেলেন। মার্কসের উপরে ইশতেহারের মূল লেখা লেখার ভার পড়ল। মার্কস ফেব্রুয়ারির মধ্যে ২৩ পৃষ্ঠার ‘Menifesto of the Communist Party’ পুস্তিকা রচনা করলেন। ১৮৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি লন্ডনের লিভারপুল থেকে জার্মান ভাষায় পুস্তিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকার বক্তব্য আজো এখনো পর্যন্ত কমিউনিস্ট সংগঠনসমূহের অবিসংবাদিত ইশতেহার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই ইশতেহার আজও মার্কস এঙ্গেলসের যৌথ রচনা হিসেবে সবার কাছে বিবেচিত হয়ে আছে।
কমিউনিস্ট ইশতেহারের শুরুতেই বলা হয়েছে-‘ইউরোপ এক ভুত দেখছে, কমিউনিজমের ভুত। পুরোনো ইউরোপের সকল শক্তি এই ভুতকে তাড়ানোর জন্য একজোট হয়েছে’। সেই ভুত যেন এই একবিংশ শতকেও দেখছে পুরো বিশ্ব!
কমিউনিস্ট ইশতেহারে ঘোষনা দেয়া হয়েছিল, “আপনদৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য গোপন রাখতে কমিউনিস্টরা ঘৃণা করে। খোলাখুলি তারা ঘোষনা করে যে, সমস্ত কায়েমি সামাজিক অবস্থার বলপূর্বক উচ্ছেদ সাধনের মাধ্যমেই তাদের লক্ষ্য পূরণ হতে পারে। কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে শাসকশ্রেনীর বুকে কাঁপন ধরুক। শৃংখল ছাড়া প্রলেতারিয়েতেরে হারানোর কিছু নেই, জয় করার জন্য আছে সারা বিশ্ব।”

ফ্রান্সের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব
১৮৪৮ সালের দিকে গোটা ইউরোপে বিপ্লবী হাওয়া বইতে শুরু করলো। প্যারিস থেকে ফেব্রুয়ারিতে তা শুরু হলো।বিপ্লবকে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবও বলা হয়।বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ সিংহাসন থেকে অপসারিত হন। দ্বিতীয় রিপাবলিক ক্ষমতায় বসে।১৮৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্সে এই বিপ্লবের ধারা অব্যাহত ছিলো।এই এই বিপ্লব ছড়িয়ে পড়লো ইতালী, হাঙ্গেরী, পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়।
তবে জুন মাসের দিকে এই বিপ্লব প্রচেষ্টা মারা্ত্মকভাবে আক্রান্ত হতে থাকে। শ্রমিকরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। জেনারেল কভেনিয়াকের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান দমানো হয়। শ্রমিকরা ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করে। ৪ দিন ধরে চলে বীরত্বপূর্ণ লড়াই। ব্যাপক রক্তপাত ঘটানো হয় এবং শ্রমিকশ্রেনী পরাজিত হয়। এতে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিককে মেরে ফেলে শাসকগোষ্ঠী।
এঙ্গেলস এই সময়ে জুন অভ্যুত্থান বিষয়ে বেশকিছু প্রবন্ধ লেখেন। তিনি সামরিক বিষয়াদি নিয়ে তার লেখায় আলোচনা করে। তিনি লেখেন, ‘লোকসংখ্যার দিক থেকে চারগুণ শক্তিশালী শত্রুর সঙ্গে প্যারিসের ৪০ হাজার শ্রমিক যদি এরূপ বিপুল সাফল্য অর্জন করতে পারে তবে একমত একজোট হলে সংঘবদ্ধভাবে প্যারিসের সমগ্র শ্রমিক’ আরো বড়কিছু করতে পারবে।

জার্মানীতে বিপ্লব প্রচেষ্টা
এঙ্গেলস ২১ মার্চ, ১৮৪৮ সালে ব্রাসেলস থেকে প্যারিসে যান। প্যারিসে জার্মান বিপ্লবীদের অনেকেই তখন অবস্থান করছিলেন। তারা ফ্রান্সের বিপ্লবের দ্বারা প্রভাবিত হলেন। প্যারিসে প্রবাসী জার্মান বিপ্লবীদের সামনে মার্কস ও এঙ্গেলস জার্মানে বুর্জোয়া বিপ্লব করার জন্য ১৭ দফা দাবি সম্বলিত করণীয় কর্মসূচি পেশ করলেন।এই ১৭ দফা জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি’র নামে কমিউনিস্ট লীগ সদস্যদের স্বাক্ষরে প্রচার করা হয়। উক্ত ১৭ দফার ভিত্তিতে পরে তারা আন্দোলন সংগ্রাম সংঘটিত করার প্রচেষ্টা চালান।
এঙ্গেলস ও মার্কস ০৭ এপ্রিল, ১৮৪৮ জার্মানীর মাটিতে পা রাখলেন।তারা রাইন অঞ্চলের কোলন শহরে অবস্থান নিলেন। এর আগে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ জার্মান বিপ্লবী নিজের দেশের সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য প্যারিস থেকে প্যারিস থেকে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে দেশে ঢুকতে লাগলেন।
ব্যাপক তৎপরতার কারণে এপ্রিলের মধ্যে কোলনে বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হলো।জুলাই মাসের মাঝামাঝি কোলনের তিনটি সংগঠনকে একত্রিত করে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে সক্ষম হলেন মার্কস ও এঙ্গেলস। জার্মান বিপ্লবীদের পত্রিকা রাইন অঞ্চলের নয়া সংবাদপত্র বা নয়া রাইনিশ্চে চাইটুং এর মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার আন্দোলন চালানো হলো। ১৩ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কোলনে অনুষ্ঠিত হয় রাইন অঞ্চলেল গণতান্ত্রিক ও শ্রমিক সংগঠনসমূহের প্রাদেশিক কংগ্রেস।
এরই মধ্যে বৃহৎ বুর্জোয়া ও প্রুশিয়া’র রাজার মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিলো।সশস্ত্র বাহিনী রাজার প্রতি আনুগত্য ঘোষনা করবে নাকি সংবিধানের প্রতি আনুগত্য ঘোষনা করবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলতে থাকলো।প্রুশিয়ার রাজা নতুন এক কৌশল আঁকলেন। তিনি ডেনমার্কেরে সাথে যুদ্ধ ঘোষনা’র নামে সৈন্যবাহিনীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলেন। অথচ কিছুদিনের মধ্যে লজ্জ্বাজনক চুক্তি করলেন। জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে রাজার বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হলো। মার্কস এবং এঙ্গেলস ১৩ সেপ্টেম্বর কোলনে প্রায় ৬ হাজার শ্রমিক জনতার এক জমায়েতে নিরাপত্তা কমিটি গঠন করলেন। সারা জার্মানী জুড়ে জনসভা ও মিছিল হতে লাগলো।কিন্তু এদিকে বুর্জোয়ারা দেখলো তাদের হাত থেকে বিপ্লবের পাল্লা শ্রমিক সংগঠনের দিকে চলে যাচ্ছে। তারা রাজার সাথে আপসরফা করার দিকে চলে গেল। এবার রাজা বিপ্লবী শক্তিকে দমনের দিকে হাত বাড়ালেন।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে কমিউনিস্ট লীগের নেতাদের ওপর গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করা হলো।শ্রমিকসংঘ ও গণতান্ত্রিক সংগঠনের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সাথে সাথে সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়।এরফলে নয়া রাইনিশ্চে চাইটুং পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। গ্রেপ্তারে এড়াতে এঙ্গেলস বারমেনে পালিয়ে গেলেন। সেখানেও তাকে খোঁজাখুজি করা শুরু হলে তিনি ব্রাসেলসে আশ্রয় নেন। পরে সেখান থেকে তিনি সুইজারল্যান্ডে পায়ে হেঁটে চলে যান সেখানে তিনি লসেনে থাকার সময় সুইস শ্রমিকদের আন্দোলনে অংশ নেন।তিনি বার্নে অনুষ্ঠিত শ্রমিক কংগ্রেসে লসেনের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। সুইজারল্যান্ডে থাকার সময় তিনি সেখানকার পত্রপত্রিকায় জার্মান পেটিবুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের ভাবধারার সমালোচনা করে প্রবন্ধ লেখেন।

‘জেনারেল’ হিসেবে পরিচিতি
তিনি ‘হাঙ্গেরীতে বৈপ্লবিক সংগ্রাম’ নামক এক প্রবন্ধে হাঙ্গেরীয়দের (ম্যাগিয়ার) বৈপ্লবিক পদ্ধতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনী ও হাঙ্গেরী’র মধ্যে লড়াইয়ের বিশ্লেষণ সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় অনেকে মনে করেছিলেন বোধহয় ছদ্মনামে কোনো হাঙ্গেরীয় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার তা লিখেছেন। অথচ এঙ্গেলস এই সকল লেখার মালমশলা সংগ্রহ করেছিলেন খবরের কাগজে অস্ট্রিয়ান সরকার যে জলজ্যান্ত মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করতো তার উপরই ভিত্তি করে।
১৮৪৯ সালের ১৮ মে নয়া রাইনিশ্চে চাইটুং পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এঙ্গেলস বর্ণনা করেন যে, অস্ট্রিয়া বাহিনী হাঙ্গেরীয়দের সাথে যুদ্ধে বলহীন হয়ে পড়ে এবং নতুন করে সেনা রিক্রুট করে যুদ্ধ করার মতো আর্থিক অবস্থাও তার ছিলো না।এদিকে হাঙ্গেরীয় বাহিনী পোল্যান্ডের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ সেনাবাহিনীর সাহায্যে তারা অস্ট্রিয়াকে ভিয়েনার কাছাকাছি হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই সময় তারা ভিয়েনা দখল না করে সেখানেই তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয় এবং হাঙ্গেরীয় এলাকাতে তাদের শক্তি সংহত করে রাখে।ততদিনে অস্ট্রিয়ার দুই লাখ সৈন্যবাহিনীর মাত্র ৫০ হাজার জন হাঙ্গেরী থেকে ফেরত যেতে পেরেছিল।
এছাড়া ১৮৭০ সালে ফ্রান্স-প্রুশিয়া যুদ্ধ সংঘটিত হলে তিনি আগ্রহের সাথে যুদ্ধের গতিবিধি অনুধাবন করে পলমল গ্যাজেটে পত্রিকায় সেই যুদ্ধ সম্পর্কে যে লেখালেখি করেন তাতেও তিনি সামরিক বিষয়ে নিখুঁত ভবিষতবাণী করতে পেরেছিলেন। ফরাসী সেনাবাহিনীর অনেকগুলি পরাজয়ের কথা তিনি আগে থেকেই ভবিষ্যতবাণী করার মতো বলে দিতে পেরেছিলেন।
পরে এই সামরিক বিষয়ে তার নিখুঁত বিশ্লেষনের জন্য মার্কসের মেয়ে তাকে জেনারেল হিসেবে ডাকতে শুরু করেন এবং অনেকেই তাকে সেই নামে ডাকতে শুরু করেন।
এলিওনর মার্কস অ্যাভেলিং এঙ্গেলস সংক্রান্ত স্মৃতিকথায় লিখছেন, “১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো প্রুশিয়ান যুদ্ধের সময়ে পলমল গ্যাজেট-এ এঙ্গেলস যে প্রবন্ধগুলি লেখেন তা দারুণ চমক সৃষ্টি করে, কারণ তাতে তিনি সেদানের যুদ্ধ ফরাসী সেনাবাহিনী চূর্ণ হওয়ার কথা আগে থেকেই বলে দিতে পেরেছিলেন। প্রসঙ্গত বলি, ওই সময় থেকেই তার ডাকনাম হয়ে যায় ‘জেনারেল’। আমার দিদি প্রথমে তার নাম দেয় ‘সেনানীমন্ডলী’।সেই থেকে নামটি টিকে যায় এবং আমরা তাকে ‘জেনারেল’ বলে ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।”

১৮৪৯ এর দিনগুলো
১৮৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুইজারল্যান্ড থেকে আবার জার্মানীর কোলনে ফিরে আসেন।তখন সেখানে বিপ্লবের দুর্দিন চলছে। লড়াই থেকে অস্থিরচিত্ত দোদুল্যমান ব্যক্তিগণ চুড়ান্ত লড়াই থেকে সরে আসছিলো।
মার্কস ও এঙ্গেলস পেটিবুর্জোয়া দোদুল্যমানতা, সুবিধাবাদিতা, কাপুরুষতা, পলায়নবাদিতা নিয়ে লেখা লিখতে শুরু করলেন। এ সময় তারা দু’জন মিলে ‘মজুরি শ্রম ও পুঁজি’ লেখা লেখেন।উক্ত লেখায় দেখানো হয়, একমাত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই শোষনের জোয়াল থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তারা পেটিবুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমিতি থেকে বেরিয়ে আসলেন। কোলন শ্রমিক সংঘকে তারা সারা জার্মানের এক শ্রমিক সংগঠনে পরিণত করতে উদ্যোগ নিলেন।
মে মাসের শেষের দিকে জার্মানীর পশ্চিম ও দক্ষিণদিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। প্রুশিয়ার রাজাসহ সামন্তীয় শক্তি ফ্রাঙ্কফুর্ট জাতীয় পরিষদের একটি সিদ্ধান্তকে নাকচ করলে এই সংগ্রাম শুরু হয়। কিন্তু সামরিক আক্রমণের মাধ্যমে এই সংগাম পরাস্ত করা হয়।
এঙ্গেলস কিছুদিনের জন্য লেখনি ছেড়ে নিজের জন্মস্থান বারমেন বা ভুপারটেলের এলবারফেল্ডে গিয়ে বন্দুক হাতে নিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করলেন। সেখানে কয়েকশ’ শ্রমিকের উপর নির্ভর করে তিনি শ্রমিকদের সশস্ত্র করাসহ বিভিন্ন কাজ করতে শুরু করলেন। কিন্তু আন্দোলনের একটি অংশ পেটিবুর্জোয়া সম্প্রদায় তার আগমনের ফলে ‘আন্দোলনের চরিত্র সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি’ হতে পারে এই কারণ দেখিয়ে তাকে চলে যেতে বলে এবং তিনি সেখান থেকে কোলনে চলে আসেন।
এরইমধ্যে বিপ্লবের পরাজয় ঘটতে শুরু করে। মার্কসকে প্যারিসে চলে যেতে হলো। এঙ্গেলস আবার অস্ত্র হাতে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর এডজুটেন্ট হয়ে বাডেন প্রদেশে গেলেন। সেখানে তিনি কমিউনিস্ট লীগের সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করলেন। কিন্তু জুলাই মাসের শুরুর দিকে প্রতিরোধ ভেঙে গেল।এঙ্গেলসসহ অন্যান্য বিপ্লবীরা সীমান্ত পার হয়ে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন।
পরে জার্মানের এই সংগ্রাম বিষয়ে তিনি তার বিশ্লেষণমূলক লেখা ‘রাজকীয় সংবিধানের জন্য জার্মান অভিযান’ লেখেন।সেখানে তিনি পেটিবুর্জোয়া নেতারা সংগ্রামরে অগ্রভাগে থেকে কিভাবে সংগ্রাম ধ্বংস করে থাকে সে বিষয়ে কথা বলেন।
এঙ্গেলস অক্টোবরের দিকে সুইজারল্যান্ড থেকে ইতালীতে এসে এক পালতোলা জাহাজে করে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে চলে আসেন।
এরইমধ্যে সারা ইউরোপে অভ্যুত্থানের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া কমিউনিস্ট লীগ পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন মার্কস। তারা আবার তাদের পত্রিকা নয়া রাইনিশ্চে চাইটুং প্রকাশ করতে শুরু করলেন। সেখানে তারা এতদিনের বাস্তব সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন।

বিপ্লবী পরিস্থিতি আর নেই
১৮৫০ সালে এসে সারা ইউরোপে বিপ্লবী পরিস্থিতি থিতিয়ে আসলো। এবার মার্কস ও এঙ্গেলস বিপ্লবের শিক্ষা ও বিপ্লবী সংগ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণমূলক লেখা রচনার কাজে হাত দিলেন। তবে এরইমধ্যে দারিদ্র্য তাদের জাপটে ধরো শুরু করেছে। তারা চরম আর্থিক কষ্টে দিন কাটাতে শুরু করলেন।
অবস্থা এমন সঙ্গীন হয়ে উঠলো যে, এঙ্গেলস নভেম্বর মাসের দিকে তার পিতার ম্যাঞ্চেস্টারে অবস্থিত কোম্পানীতে আবার কাজে যোগ দিতে বাধ্য হলেন। তিনি চাকুরি করে মার্কসকে কিছু অর্থ পাঠাতে শুরু করলেন। আর্থিক সাহায্য পেয়ে মার্কস ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশুনার সময় পেলেন। তিনি ফ্রান্সের বিপ্লব নিয়ে লিখলেন ‘লুই বোনাপার্টের আঠারই ব্রুমেয়ার’ ও ‘ফ্রান্সে শ্রেনী সংগ্রাম- ১৮৪৮ থেকে ১৮৫০’। এঙ্গেলস রচনা করলেন ‘জার্মানীতে কৃষকযুদ্ধ’ ও ‘জার্মানীতে বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব’।
১৮৫২ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে জার্মানীর কলোনে কমিউনিস্ট লীগের বন্দী ১১ সদস্যের বিচার শুরু হয়। তাদের দীর্ঘমেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়। মার্কসের প্রস্তাবে ১৮৫২ সালের ১৭ নভেম্বর কমিউনিস্ট লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষিত হয়। উপদলীয় কার্যকলাপের কারণে ও দমনপীড়ন বেড়ে যাওয়া লীগের অস্তিত্ব বজায় রাখা ‘সময়োচিত হবে না’ বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।শেষ হয় আন্দোলনের একটি অধ্যায়ের।

এঙ্গেলসের ২০ বছরের ‘কঠোর বন্দীদশা’র চাকুরি জীবন
এঙ্গেলস আশা করেছিলেন তিনি চাকুরি জীবনের ‘অভিশপ্ত বন্দীদশা’ থেকে খুব তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবেন। কিন্তু তাকে চাকুরি করতে হলো ১৮৫০ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত ২০ বছর ধরে। প্রথমে তিনি তার পিতার এরমেন এন্ড এঙ্গেলস ফার্মটির বাণিজ্যিক সংবাদ দাতা হিসেবে চাকুরি করেন। পরে ১৮৬০ সাল থেকে কাজ করেন প্রতিনিধি হিসেবে। এবং ১৮৬৪ সালের পরে তার পিতার মৃত্যু হলে তিনি ফার্মটির অংশীদার হয়ে ওঠেন।
১৮৬৩ সালের ০৬ জানুয়ারি এঙ্গেলসের স্ত্রী মেরি বার্নসের মৃত্যু হয়। পরে তিনি মেরির বোন লিজি বার্নসের সাথে সংসার করেন। ১৮৭৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর লিজি’র মৃত্যু হয়। এঙ্গেলসের কোনো সন্তান ছিলো না।

মার্কস এঙ্গেলস শ্রমবিভাজন
চাকুরি জীবনের সময়েও দুই বন্ধুর সম্পর্ক ও চিঠি লেখালেখি এবং পরামর্শ সহযোগিতা গ্রহণ নিয়মিত ছিলো। তারা দুইজনে যেন স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলেন তাদের শ্রমবিভাজন।এঙ্গেলস অর্থ আয় করেন ও তা দিয়ে নিজের ও মার্কসের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বভারও গ্রহণ করেন।মার্কস যেন নির্বিঘ্নে লেখালেখির কাজ করে যেতে পারেন মূলত: তার জন্যই তো এঙ্গেলস চাকুরি নিয়েছিলেন।

নিউ ইয়র্ক ডেইলী ট্রিবিউনে মার্কসের হয়ে লেখালেখি
১৮৫১ সালের আগস্ট মাসে মার্কস আমেরিকার ডেইলী ট্রিবিউনে কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লেখালেখির সুযোগ পান। কিন্তু তখনো তিনি ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেননি। এঙ্গেলস তার বন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিলেন। তিনি ইংরেজি ভাষায় প্রবন্ধ লিখে মার্কসকে পাঠাতেন। মার্কস তা নিজের নামে পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতেন। বেশ কয়েক বছর ধরে মার্কস উক্ত পত্রিকায় লেখালেখি করেন। তার মধ্যে প্রায় একতৃতীয়াংশ লেখা ছিলো এঙ্গেলসের।তিনি এসব অনেক লেখায় তার সামরিক জ্ঞানের পরিচয় প্রদান করেন।

আয়ারল্যান্ডে স্ত্রীর সাথে এঙ্গেলস
১৮৫৬ সালের দিকে এঙ্গেলস ও তার স্ত্রী মেরি বার্নস আয়ার্যাচন্ডে যান।ইংল্যান্ড সরকার আয়ারল্যান্ডকে তখন নামমাত্র আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রদান করেছে। এ বিষয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করে মার্কসকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি বলেন, ‘লৌহ হস্ত’ আয়ারল্যান্ডের সর্বত্র দৃশ্যমান। সরকার সব জায়গায় তার খবরদারী বজায় রাখে, কোথাও স্বায়ত্তশাসনের চিহ্ন দেখা নেই।ইংল্যান্ড সরকার এখনো আয়ারল্যান্ডকে তার কলোনী হিসেবেই শাসন করছে। তিনি আরো বলেন, ১১০০ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডকে ইংল্যান্ডকে অবরোধ করে রাখায় দেশটিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। আইরিশ অর্থনীতি ও তার সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সব ধ্বংস করে দিয়েছে। আইরিশরা এখন তাদের দেশকে নিজের দেশ ভাবে না। চিঠির শেষে তিনি বলেন, ইংল্যান্ড দেশটিকে শাসনে রাখার পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিয়েছে নিপীড়ন চালিয়ে ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে।প্রায় দেড়শ বছরের অধিক আগে এঙ্গেলস আয়ারল্যান্ড নিয়ে যে কথা বলেছিলেন তা যেন অক্ষরে অক্ষরে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর চলমান রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বৈষম্যকে স্মরণ করে দেয়।
১৮৭০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে
২০ বছর চাকুরির পরে এঙ্গেলস বুঝতে পারলেন যা আয় করেছেনে তা দিয়ে জীবন চালাতে আর চাকুরি না করলেও চলবে। তিনি ফার্মের মালিকানাস্বত্ব বিক্রি করে দিয়ে লন্ডনে চলে আসলেন। বাড়ি নিলেন মার্কসের বাড়ির অদূরে ১০ মিনিটের হাঁটাপথ দুরত্বে।তারা একত্র হবার পর প্রতিদিন দু’জনে মিলিত হতেন এবং ঘন্টার পর ঘন্টা তারা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের আলোচনা চালিয়ে যেতেন।
এরই মধ্যে ১৮৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাসল (Basle)এ কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একটি কংগ্রেস বসে। এই সময় ছদ্ম বিপ্লববাদের বিপরীতে কংগ্রেসে মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তাধারা প্রাধান্য পায়। এখানে বলা প্রয়োজন, ১৮৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে লন্ডনের সেন্ট মার্টিন হলে প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং ম্যানস এসোসিয়েশন গঠন করা হয়। উক্ত সংগঠনে প্রথমদিকে ব্রিটিশ সংস্কারবাদী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, ফ্রেঞ্চ র্যা ডিকেলস ও প্রুধোঁপন্থীরা, ইতালীর মাজিনিপন্থীরা ও রাশিয়ান নৈরাজ্যবাদীরা যুক্ত হন। মার্কসকে তারা সংগঠনের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।১৮৭৬ পর্যন্ত প্রথম আন্তর্জাতিকের অস্তিত্ব ছিলো। এরপর দ্বিতীয় আনর্জাতিক গঠন করা হয় ১৮৮৯ সালের জুলাই মাসে।
১৮৭০ সালে এঙ্গেলস লন্ডনে আসলে মার্কসের প্রস্তাবনামতে তিনি ইন্টারন্যাশনালের সাধারণ পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। এঙ্গেলস তার পান্ডিত্য-ভাষাজ্ঞান-দূরদর্শিতার কারণের কিছুদিনের মধ্যেই ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিগণিত হন। তিনি প্রথমে বেলজিয়ামের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও পরে স্পেন, ইতালী ও ডেনমার্কের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মার্কস ও এঙ্গেলসের প্রচেষ্টায় উক্ত সংগঠনের কাজ প্রায় ১০টির অধিক দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাকুনিন পন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম
সুইজারল্যান্ডে বসবাস করা রাশিয়ান নেতা মিখাইল আলেক্সান্দ্রোভিচ বাকুনিন বা মিখাইল বাকুনিন ১৯৬৮ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সদস্য হন। তিনি কোনো সাংগঠনিক শৃংখলায় বিশ্বাস করতেন না এবং শ্রমিকশ্রেনীর সংগঠিত রাজনৈতিক পার্টি গড়ে তোলার বিপক্ষে ছিলেন। তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে বিপ্লব হবে বলে মনে করতেন।তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থা এমনকি প্রলেতারীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করারও বিপক্ষে ছিলেন। তিনি বলতেন সমাজে কোনো কর্তৃত্ব বলে কিছুই থাকবে না। তার তিনি শ্রমিক শ্রেনীকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার জন্য মার্কসকে অভিযুক্ত করতেন। তার এই মতবাদ প্রথমে বিপ্লবী মনে হলেও শেষ পর্যন্ত তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে।বাকুনিনের এই মতবাদ প্রথম দিকে ইন্টারন্যাশনালে সাড়া ফেলে। অনেকে তার মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। বাকুনিনের এ ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে মার্কস ও এঙ্গেলস যৌথভাবে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে লড়াই করে যান। তারা বোঝাতে সক্ষম হন যে, বাকুনিনপন্থীদের বিপ্লবী বুলির অর্থ হলো সকল ধরণের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ও প্রলেতারীয় বিপ্লবী পার্টির বিলোপ সাধন করা।পরে ১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বরে হেগে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে এই মতধারা পরাজিত হয় এবং বাকুনিনকে বহিষ্কার করা হয়।
এ সময় এঙ্গেলস ‘কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে’ শিরোনামযুক্ত লেখায় বাকুনিনের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনামূলক লেখায় বলেন- “তারা দাবি করে যে সমাজ বিপ্লবের প্রথম কাজই হবে কর্তৃত্বের বিলোপ সাধন। এই ভদ্রমহোদয়গণ কি কখনও বিপ্লব দেখেছেন? কর্তৃত্বমূলক যত ব্যাপার আছে তার মধ্যে নিশ্চয়ই সবচেয়ে কর্তৃত্বপ্রধান হলো বিপ্লব।বিপ্লব হলো এমন এক কর্ম যাতে জনসংখ্যার এক অংশ কর্তৃত্বাশ্রয়ী উপায় আদৌ যা আছে সেই বন্দুক, বেয়নেট ও কামানের মাধ্যমে জনসংখ্যার অপর অংশের উপর নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়।আর বিজয়ী দল যদি নিজেদের সংগ্রাম ব্যর্থ হতে দিতে না চায় তাহলে তাদের নিজেদের শাসন বজায় রাখতে হবে অস্ত্রের সাহায্যে প্রতিক্রিয়াশীলদের মনে ভীতি সঞ্চার করেই।”

প্যারি কমিউনের অভিজ্ঞতা
১৮৭০ সালের মে মাসের ১৮ তারিখ ফ্রান্সের শ্রমিক জনগণ প্যারিসে শ্রমিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে যা প্যারী কমিউন নামে সমধিক পরিচিত। মূলত, সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন নিজের ক্ষমতা সংহত করতে ১৮৭০ সালের ১৯ জুলাই প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। যুদ্ধে তৃতীয় নেপোলিয়নের পরাজয় ঘটে এবং বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে নেয়। ১৮৭০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সকে প্রজাতন্ত্র ঘোষনা করা হয়। প্রুশিয় বাহিনী ক্রমে প্যারিসে চলে আসতে থাকে।১৮৭১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে বুর্জোয়া বাহিনী প্রুশিয় বাহিনীর জবরদস্তিমূলক সন্ধিশর্ত মেনে নেয়। কিন্তু প্যারিসের প্রায় ৩ লক্ষ শ্রমিক বাহিনীত তা মানতে অস্বীকার করে। বুর্জোয়া বাহিনী জোর করে শ্রমিকবাহিনী থেকে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়। শ্রমিকরা বিদ্রোহ করে এবং ১৮ মার্চ সিটি হল দখল করে লাল পতাকা উড়িয়ে দেয়।
প্রুশিয় বাহিনী ও ফ্রান্সের মধ্যে চলা যুদ্ধ সম্পর্কে এঙ্গেলস ও মার্কস যুদ্ধ শুরু থেকেই লেখালেখি করে প্রুশিয় সরকার ও ফ্রান্সের বুর্জোয়া বাহিনীর মুখোশ উন্মোচন করতে সচেষ্ট ছিলো। প্রুশিয় বাহিনী যে জার্মান জনগণের পক্ষে লড়ছে না এবং ফ্রান্সের বাহিনীও যে ফ্রান্সের জনগণের জন্য লড়ছে না তা নিয়ে এঙ্গেলস ও মার্কস বহু লেখা লেখেন।
প্যারী কমিউন প্রায় ৭২ দিন টিকে ছিল। ১৮৭১ সালের ২৮ মে প্যারিসের পতন ঘটে। এবং মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ৩০ হাজার নগরবাসীকে হত্যা করে বুর্জোয়া বাহিনী।
কার্ল মার্কসের ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ নামক বইয়ের ভূমিকা অংশে এঙ্গেলস প্যারিস কমিউন বিষয়ে আলোচনাকালে ‘তত্ত্বসর্বস্বতার’ সমালোচনা করেন।তিনি বলেন, এবং উভয়ক্ষেত্রেই ইতিহাসের পরিহাস এই – তত্ত্বসর্বস্ব(মতসর্বস্ব) ব্যক্তিরা কর্তৃত্বে আসলে সচরাচর যা ঘটে, তা হলো, নিজ মতাদর্শ অনুসারে তাদের যা করণীয় তার বিপরীত কাজই তারা করে বসল। উল্লেখ্য, প্যারিস কমিউন গঠনের সংগ্রামে ফ্রান্সের বামপন্থী ব্লাঙ্কিপন্থী ও প্রুধোঁপন্থী দুই বিপ্লবীগোষ্ঠী অংশ নিয়েছিল।
পরবর্তিকালে প্যারী কমিউন কেন বিজয় ধরে রাখতে পারেনি তার উপরও লেখা লেখেন মার্কস ও এঙ্গেলস।

সমাজতান্ত্রিক পার্টিসমূহের মধ্যে ঐক্য প্রসঙ্গে
১৮৭৫ সালের দিকে জার্মানীতে সমাজতন্ত্রীদের উপর নির্যাতন বাড়তে থাকে। এই সময় সক্রিয় দু’টি সোশ্যাল ডেমোক্রেট পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রশ্ন চলে আসে।লিবনেখট, বেবেল, বার্নস্টাইনের নেতৃত্বে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক শ্রমিক পার্টি ও লাসালপন্থীদের জেনারেল এসোসিয়েশন অব জার্মান ওয়ার্কার্স-এর মধ্যে এই ঐক্য হয়।
মার্কস ও এঙ্গেলস তড়িঘড়ি ও নীতিহীন ঐক্যের সমালোচনা করেন।১৮৭৫ সালের মার্চ মাসে বেবেলকে লেখা এক চিঠিতে এঙ্গেলস ঐক্যের সময় শ্রমিক শ্রেনীর আন্তর্জাতিকতাবাদী নীতিকে ভিত্তি হিসেবে না রাখার কড়া সমালোচনা করেন। এছাড়া বেতনের কড়া নিয়ম সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত, শ্রেনী হিসেবে শ্রমিক শ্রেনীর সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন থাকা বিষয়ে কোনো আলোচনা সিদ্ধান্ত না থাকা, মুক্ত রাষ্ট্র ধারণা ইত্যাদির সমালোচনাও তিনি ঐ চিঠিতে করেন। প্রলেতারীয় একনায়কত্বের বিপরীতে লাসালপন্থীদের ফ্রি পিপলস স্টেট বা স্বাধীন গণরাষ্ট্র ধারণা গ্রহণের সমালোচনাও তিনি উক্ত লেখায় করেন।
পরে একই বছরের মে মাসের দিকে মার্কস এই নীতিচ্যুত ঐক্যের সমালোচনা করে ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’ নামে পুস্তক রচনা করেন।বইয়ে তিনি জার্মান সমাজতান্ত্রিক পার্টিকে সতর্ক করে বলেন, লাসালপন্থীদের সাথে আপসধর্মী ঐক্য অনিবার্যভাবে পার্টির ভবিষ্যত বিকাশের উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
১৮৭৫ সালে বেবেলকে লেখা এক চিঠিতে এঙ্গেলস বলেন- আপনার মনে রাখা দরকার যে, জার্মান সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক শ্রমিক পার্টির প্রতিটি উক্তি ও কাজের জন্য বিদেশে আমাদেরই দায়ী করা হয়। …। আমরা এখান থেকে সমস্ত ব্যপারটা চালাচ্ছি, এ কথা ভাবতেই লোকের ভাল লাগে, অথচ আমাদের মতোই আপনিও ভালভাবেই জানেন যে, আমরা প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই পার্টির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিনি, করে থাকলেও করেছি যখন আমাদের মতে কোনো ভুল, এবং কেবলমাত্র তত্ত্বগত ভুল করা হয়েছে তখন সম্ভবত তার সংশোধনের জন্যই। কিন্তু আপনি নিজেই বুঝতে বুঝতে পারবেন যে, এই কর্মসূচি হল একটা মোড় পরিবর্তন। যে পার্টি এমন কর্মসূচি মেনে নেয় তার প্রতি কোনো রকম দায়িত্ব এরফলে অস্বীকার করতে আমরা সহজেই বাধ্য হতে পারি।

এ্যান্টিডুরিং
বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইউজিন ডুরিং সেকেলে বাতিল বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা পেটি বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের এক পাঁচমিশালী জগাখিচুড়ি ব্যবস্থা উপস্থাপন করেছিলেন, যাতে বাগাড়ম্বর কথা ছিলো কিন্তু সারবস্তু বলতে কিছুই ছিল না।
ডুরিং-এর বক্তব্য দ্বারা অনেকেই প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই এ বিষয়ে জবাব রচনা করা তখন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। ১৮৭৭ সালে এঙ্গেলস এ বিষয়ে ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন এবং তা বই আকারে ১৮৭৮সালে প্রকাশিত হয়।বইটির শিরোনাম ছিলো- হের ওগেন ডুরিংএর বিজ্ঞান বিপ্লব বা সংক্ষেপে এ্যান্টি ডুরিং। উক্ত লেখায় তিনি সমাজতান্ত্রিক দর্শন বা তত্ত্ব দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ নিয়ে আলোচনা করেন।
স্বাধীনতা প্রসঙ্গে এ্যান্টি ডুরিং-এ বলা হয়েছে, ‘প্রকৃতির বিধানসমূহ থেকে কোনো কাল্পনিক বিমুক্তির মধ্যে স্বাধীনতা নিহিত নয়। প্রকৃতির বিধানসমূহের জ্ঞান এবং সেই জ্ঞানের মাধ্যমে এই বিধানসমূহকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সাধনে সুশৃংখলভাবে নিযুক্ত করার যে সম্ভাবনা আমরা লাভ করি তার মধ্যেই আমাদের স্বাধীনতা নিহিত।…। কাজেই তথ্য তথা বাস্তব জগত সম্পর্কে জ্ঞানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। এছাড়া আর কিছু নয়। কাজেই কোনো প্রশ্নের বিবেচ্য বিষয়ে মানুষের সিদ্ধান্ত যত অধিক স্বাধীন হবে, তত অধিক অনিবার্যভাবে তার সে স্বাধীনতা নির্দিষ্ট হবে। অন্যদিকে অজ্ঞানতা থেকে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয় এবং যার কারণেই বিভিন্ন এবং পরষ্পরবিরোধী সম্ভাবনাসমূহের মধ্যে যদৃচ্ছাভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব বলে আমাদের বোধ হয়, আসলে সেই অনিশ্চয়তাই একথা প্রমাণ করে যে আমাদের এরূপ সিদ্ধান্ত স্বাধীন নয়। কারণ, যাকে নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য তাকে তথা বাস্তব অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সে বাস্তব অবস্থারই অজ্ঞতা দ্বারা।কাজেই স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে প্রকৃতির অনিবার্যতার জ্ঞানের ভিত্তিতে বহির্জগত এবং আমাদের নিজেদের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ।’(উদ্ধৃতিটি সরদার ফজলূল করিম অনুদিত এঙ্গেলস এর এ্যান্টি ডুরিং থেকে নেয়া হয়েছে)।
এই বক্তব্যটির মূল অর্থ আমরা এভাবে বর্ণনা করতে পারি যে, একটি বিষয় বা নির্দিষ্ট প্রশ্নে মানুষ স্বাধীনভাবে ও সুনির্দিষ্টতার সাথে বা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে তখনই সক্ষম হয় যখন মানুষ উক্ত বিষয় বা উক্ত প্রশ্ন সম্পর্কে পুরো ধারণা বা জ্ঞান লাভ করতে পারে। স্বাধীনতা তাকেই বোঝায় যখন আমাদের নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং বহিঃপ্রকৃতির উপর আমরা পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে পারি, যার ভিত্তি হলো প্রাকৃতিক প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে জ্ঞানলাভ (A control founded on knowledge of natural necessity)।

এ্যান্টি ডুরিং-কে বলা হয় মার্কসবাদের বিশ্বকোষ। মূলত, ডুরিং-এর দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করা হলেও সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক অঙ্গ বিষয়ে আলোচনার কারণে বইটি তাৎপর্য এখনো মার্কসবাদীদের কাছে মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত।
প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা বা Dialectics of Nature
প্রকৃতির মধ্যে দ্বান্দ্বিকতা প্রমাণ করাই এই রচনার উদ্দেশ্য। ১৮৭৩ সাল থেকে তিনি বইটি লেখার কাজ শুরু করেন। কার্ল মার্কসের মৃত্যুর পরে তিনি বইটি শেষ করার কাজে আর হাত দেননি। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বইটি প্রকাশ করা হয়।
দ্বন্দ্বতত্ত্বের তিনটি নীতি- একই বস্তুর মধ্যে পরষ্পরবিরোধী গুণের ঐক্য, পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন এবং বিপরীতভাবে গুণগত পরিবর্তন থেকে পরিমাণগত পরিবর্তন এবং নেতির নেতিকরণের বা বিকাশের পথেই অবলুপ্তি ও অবলুপ্তির পথেই বিকাশ-এই নীতিনিয়মই প্রকৃতির বিকাশের মূলসূত্র হিসেবে তিনি তার এই লেখায় প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃতি বর্তমান শুধু তাই নয়, তার উদ্ভব ও রূপান্তর ঘটে।’
বইটির মধ্যে থাকা ‘বানর থেকে মানুষে উত্তরণে শ্রমের ভুমিকা’ লেখাটিতে তিনি মানুষের দেহযন্ত্র গঠন, ভাষার উৎপত্তি ও মানব সমাজ গঠনে যে শ্রমের ভুমিকা রয়েছে তা তিনি আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র এই মতই দেয় যে, শ্রমই হলো সকল সম্পত্তি বা সম্পদের উৎসমূল। এবং এটাই হলো বাস্তবিক উৎসমুখ-প্রকৃতির সম্মুখবর্তী-যা উপাদান হিসেবে সরবরাহ হয়ে সম্পদে পরিণত হয়।কিন্তু তা সীমাহীনভাবে তার চেয়েও বেশি। তা বা এই শ্রম হলো সকল মানবিক জীবনের প্রাথমিক মূলগত শর্ত।একদিক থেকে বলতে হবে যে, একটা পরিমাণে স্বয়ং মানুষই হলো শ্রমের সৃষ্টি।’
পোল্যান্ড-আইরিশ স্বাধীনতা প্রশ্নে এঙ্গেলস: সত্যিকার জাতীয়তাবাদীই হতে পারেন আন্তর্জাতিকতাবাদী
পোল্যান্ডের উপর কার্ল কাউটস্কিকে ১৮৮২ সালের ০৭ ফেব্রুয়ারি এঙ্গেলস একটি চিঠি লেখেন।তিনি উক্ত লেখায় বলেছিলেন, ঐতিহাসিকভাবে এমনকি একজন মহান ব্যক্তির পক্ষেও যে কোনো প্রকার সমস্যাদি বিষয়ে গভীর চিন্তা করা সম্ভব হয় না, যতদিন পর্যন্ত জাতীয় মুক্তি অর্জন সম্ভব হয় না ততদিন পর্যন্ত। যেমন, ১৮৫৯ সালের আগে ইতালীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি।
তিনি মন্তব্য করেছেন, শ্রমিকশ্রেনীর একটি আন্তর্জাতিকবাদী লড়াই একমাত্র স্বাধীন জাতিসমূহের মধ্যেই সম্ভবপর।
লেখায় তিনি আরো মত প্রকাশ করে বলেছিলেন, আামি এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি, ইউরোপের মধ্যে দুইটি জাতির আন্তর্জাতিকতাবাদী হওয়ার আগে জাতীয়তাবাদী হওয়াটা একইসাথে অধিকার এবং দায়িত্ব হিসেবে বর্তায়। সেই দু’টি জাতি হলো আইরিশ ও পোলিশ জাতি।তারা যদি জাতীয়তাবাদী হয় তবেই বরং তারা সর্বতো প্রকারে আন্তর্জাতিকতাবাদী।
এছাড়া তিনি আরো বলেন, অনস্বীকার্যভাবে তাদের স্বাধীন হবার আকাংখাকে বাধাগ্রস্ত করার মতো কারণ কোনোভাবেই আমাদের থাকতে পারে না। তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত পোল্যান্ড বিভক্ত ও পদানত থাকবে ততদিন পর্যন্ত সেদেশে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক পার্টি গঠিত হবে না এবং সেখানে পোল্যান্ড ও জার্মানীর মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবাদী ধারার সম্প্রীতিও গড়ে উঠবে না।
তারপর তিনি বলেন, লড়াইয়ের জন্য প্রথমে চাই দাঁড়াবার শক্ত জমি, আকাশ, আলো ও প্রশস্ত জায়গা। নতুবা বাকি সকল কিছুই বাগাড়ম্বরমাত্র।
প্রসঙ্গত, এখানে বলা প্রয়োজন যে, মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের বিভিন্ন লেখায় পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির সপক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। ১৮৪৭ সালে পোল্যান্ডের সমস্যা বিষয়ে প্রদান করা এক বক্তৃতায় এঙ্গেলস বলেছিলেন-একটি জাতি একই সময়ে অন্য জাতিসমূহের উপর নিপীড়ন জারি রেখে নিজের জাতির মুক্তি আনতে পারে না। জার্মান বা জার্মান জাতির মুক্তি ততদিন পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতদিন পর্যন্ত জার্মান পোল্যান্ডকে তার নাগপাশ থেকে মুক্ত না করে।

মার্কসের মৃত্যুর পরে
১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ বিকালের দিকে মার্কসের মৃত্যু হয়। ১৮৪২ বা ১৮৪৪ থেকে মার্কস ও এঙ্গেলস দু’জনে মিলে একাকার হয়ে যেভাবে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও তার দর্শনকে শক্ত ভিত্তিভুমির উপর দাঁড় করানোর শ্রমসাধ্য কাজটি করে যাচ্ছিলেন, এ পর্যায়ে এসে যেন তা বাধাগ্রস্ত হলো। কিন্তু এঙ্গেলস থেমে থাকলেন না। তিনি বলতেন, মার্কস ছিলেন মূল বেহালা বাদক, তিনি দোহার মাত্র। কিন্তু এবার তাকে মূল বেহালা বাদকের ভূমিকা নিতে হলো। মার্কসের অসমাপ্ত যে তত্ত্বগত কাজ ছিলো তা শেষ করার ভার নিলেন তিনি। মার্কস ‘পুঁজি’ বা ‘ডাস ক্যাপিটাল’এর প্রথম খন্ড মাত্র শেষ করতে পেরেছিলেন। এঙ্গেলস দীর্ঘ ১০ ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে মার্কসের সেই শেষ না করে ফেলে যাওয়া কাজটি শেষ করলেন।
মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখালেখি বিষয়ে পোল লাফার্গ বলেছিলেন- পয়সাকড়ি আর জ্ঞান সবকিছুই ছিলো দুই বন্ধুর যৌথ সম্পত্তি।
এই দুই বন্ধু তাদের যা লেখা প্রকাশ করেছেন তা নিজেদের একক সম্পত্তি নয় বরং দুইজনের যৌথ সম্পদ মনে করতেন।

পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি
১৮৮৪ সালে এঙ্গেলস এই বইটি লেখেন।ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে সমাজ বিকাশের বিশ্লেষণকে আরো অধিক প্রামাণ্য আকারে সূত্রাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তার এই বই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। তিনি সমকালীন ডারউইনের প্রজাতির বিবর্তন সংক্রান্ত বই ও লুইস হেনরী মর্গানের ‘প্রাচীন সমাজ’ বইয়ে আদিযুগের মানব সমাজের বিকাশ সংক্রান্ত গবেষণার সূত্র ধরে তার এই বইটি রচনা করেন। তিনি দেখান যে, এ যাবৎকালের সকল সমাজের বিকাশের ইতিহাস হলো শ্রেনী সংগ্রামের ইতিহাস।
তিনি দেখান যে, সম্পত্তি বা ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টির কারণেই বন্যাবস্থার সমষ্টিগত বিবাহ প্রথা বা পরিবার প্রথা ভেঙে বর্বরযুগে জোড়বাঁধা বিবাহ বা পরিবারে রূপান্তরিত হলো এবং পরে সভাতার যুগে বা বর্তমানের আধুনিক একপতিপত্নী সম্পর্কের উদ্ভব হলো।
একপতিপত্নী প্রথার উদ্ভব এবং কেন নারীর জন্য একপতিত্ব বাধ্যতামূলক অথচ পুরুষের বহুপত্নীত্বে বাধার সৃষ্টি হয়নি সে বিষয়ে তিনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদী বিশ্লেষণ সহকারে মত দিয়ে বলেন-‘একই ব্যক্তির, মানে এক পুরুষের অধিকারে প্রচুর সম্পত্তি কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে এবং অপর কাউকে নয়, কেবলমাত্র সে পুরুষের নিজের সন্তানসন্ততিকেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিয়ে যাবার ইচ্ছা থেকেই এই একপতিপত্নী প্রথা আসে। এই জন্যই নারীর পক্ষেই একপতিত্ব বাধ্যতামূলক, পুরুষের জন্য নয়। অতএব স্ত্রীলোকদের একপতিত্বে পুরুষদের গোপন বা প্রকাশ্য বহুপতিত্ব বাধেনি।’ তিনি আশাপ্রকাশ করেন, সমাজবিপ্লবের মাধ্যমে বর্তমান শ্রেনী বিভাজিত একপতিপত্নী প্রথার অর্থনৈতিক ভিত্তি লোপ পেলে পতিতাবৃত্তি তথা বহুপত্নী প্রথারও লোপ সম্ভবপর হবে। তবে নারী পুরুষের সমমর্যাদা অর্জনের ধারাবাহিক ঐতিহাসিক বিকাশ কিরূপ পরিগ্রহ করবে তা নিয়ে তিনি কোনো ‘গোঁড়াধর্মী’ বা ‘ডগমেটিক’ সিদ্ধান্ত টানেননি।
তিনি শুধু এই মন্তব্য করেছেন- ‘অতএব আমরা এখানে পুঁজিবাদী উৎপাদনের আসন্ন বিলোপের পরে কিভাবে যৌন সম্পর্ক পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে যে আন্দাজ করতে পারি সেটা প্রধানত, নেতিমূলক চরিত্রের কেবলমাত্র কী কী লোপ পাবে তাই নিয়ে সীমাবদ্ধ।কিন্তু কোন কোন জিনিষের উদ্ভব হবে? সেটি দেখা দেবে নতুন পুরুষ গড়ে উঠবার পর, এমন সব পুরুষ যাদের কখনো পয়সা বা অন্য কোনো সামাজিক ক্ষমতা দিয়ে কোনো স্ত্রীলোককে খরিদ করার কারণ ঘটেনি, আর এমন সব নারী যারা সত্যকার প্রেমের অনুভূতি ছাড়া আর কোনো কারণে পুরুষের কাছে আত্মদানে বাধ্য হয়নি, অথবা যাদের কোনো অর্থনৈতিক ফলাফলের ভয়ে প্রণয়পাত্রের কাছে আত্মদানে বিরত হতে হয়নি। এই ধরণের সব লোক একবার আবির্ভুত হলে আজ আমরা তাদের করণীয় বলে কী ভাবি, সে নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হবে না। তখন তারা চালু করবে নিজেদের আচার এবং ব্যক্তি আচরণ বিষয়ে নিজেদের সামাজিক মত, যা তার সঙ্গেই মিলবে, এই বলা যায়।’(কার্ল মার্কস ফ্রেডারিক এঙ্গেলস রচনা সংকলনের তৃতীয় খন্ড থেকে এই দীর্ঘ উদ্বৃতি নেয়া হলো।)

পরবর্তিতে সমাজের মধ্যে শ্রমবিভাজনের প্রয়োজনে কিভাবে শ্রেনী ও শ্রেনী শোষনের সৃষ্টি হলো তা তিনি ব্যাখ্যা সহকারে তার বইয়ে আলোচনা করেন। এবং শেস পর্যন্ত তার উপসংহার এই যে, এই শ্রেনী শোষনের ভিত্তিভুমির উপরই সৃষ্টি হলো রাষ্ট্র।আগে কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিলো না, কিন্তু মানব সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশের কারণে একটি বিশেষ স্তরে অনিবার্যভাবেই শ্রেনীবিভাগের সৃষ্টি হলো এবং এই শ্রেনী বিভাগের কারণে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা এসে গেল।
এঙ্গেলস পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি গ্রন্থে বলেন, “যেহেতু রাষ্ট্রের আবির্ভাব শ্রেনী-বিরোধকে সংযত করার প্রয়োজন থেকে, সেই সঙ্গে তার উদ্ভব হয় শ্রেনী-বিরোধের মধ্যেই। সে জন্যে রাষ্ট্র হল সাধারণত, সবচেয়ে শক্তিশালী ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রভুত্বকারী শ্রেনীর রাষ্ট্র, এই শ্রেনী রাষ্ট্রের মাধ্যমে রাজনীতির ক্ষেত্রেও আধিপত্যকারী শ্রেনী হয়ে ওঠে এবং তার ফলে নিপীড়িত শ্রেনীর দমন এবং তার শোষনে নতুন হাতয়ার লাভ করে। এইভাবে প্রাচীন যুগে রাষ্ট্র ছিল সর্বোপরি ক্রীতদাসের দমনের জন্য দাসমালিকদের রাষ্ট্র, যেমন সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল ভূমিদাস কৃষকদের বশে রাখার জন্য অভিজাতদের সংস্থা এবং আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র হচ্ছে পুঁজি কর্তৃক মজুরি শ্রম শোষনের হাতিয়ার।”
এভাবে কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস একে একে অর্থনীতি-সমাজ-রাজনীতি-রাষ্ট্র-ধর্ম-প্রকৃতি-বিজ্ঞান ইত্যাদি প্রতিটি সমাজ জীবন সংশ্লিষ্ট জ্ঞানশাখায় বিচরণ করে তাদের সমাজ বিকাশের দর্শনকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর প্রয়াস নেন তাদের মৃত্যু অবধি। শুধু তাতেই তারা ক্ষান্ত ছিলেন না; তারা বাস্তব জীবনে লড়াইয়ের মধ্যে থেকেছেন, সংগ্রাম করেছেন, সংগ্রামে শরীক হয়েছেন এবং সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন।

এঙ্গেলস গোপনে আমেরিকা সফর করলেন
১৮৮৮ সালের ০৮ আগস্টে এঙ্গেলস বার্লিন থেকে সমুদ্রপথে গোপনে আমেরিকার পথে রওনা হলেন। তিনি সেখানে একমাসের বেশি সময় কাটান। সেখানে তিনি আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক নেতাদের সাথে আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর এঙ্গেলস সেখান থেকে লন্ডনে ফিরে আসেন।

রাজনৈতিক বাস্তব কাজে এঙ্গেলসের অংশগ্রহণ
এরপর তিনি তার লেখালেখি কাজের পাশাপাশি শ্রমিক জনতার আন্তর্জাতিক কংগ্রেস আয়োজনের প্রস্তুতি কাজ কিছুদিন সময় দেন। ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে ২০টি দেশের পার্টি প্রতিনিধিদের আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এঙ্গেলস ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকতে না পারলেও তা প্রতিষ্ঠায় তিনি অনন্যসাধারণ ভুমিকা রাখেন।
১৮৯০ সালের ৪ মে লন্ডনে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস পালন করা হয়। এতে বিভিন্ন দেশের শ্রমিক নেতারা অংশগ্রহণ করেন। সমাবেশে প্রায় ৩ লাখ শ্রমিক অংশ নেন। এঙ্গেলসও তাতে অংশগ্রহণ করেন।
শেখর দত্ত ‘কীর্তিময় এক বন্ধুত্ব’ গ্রন্থে লিখছেন, মার্কসের মৃত্যুর পরে “এঙ্গেলসের তখনকার বাড়ি ১২২ নম্বর রিজেন্ট পার্ক সমগ্র বিশ্বের প্রলেতারিয়েতের তীর্থস্থান হয়ে উঠেছিল। ইউরোপ আমেরিকাসহ সমগ্র বিশ্বের প্রলেতারিয়েতেরে নেতারা এঙ্গেলসের সাথে দেখা করার জন্য ইংল্যান্ডে আসতেন। শুধু নেতারাই নয় প্রলেতারীয় বাহিনীর প্রতিটি সাধারণ সৈনিকের জন্যও জেনারেলের দরজা সর্বদা অবারিত থাকত।”

ধর্ম সম্পর্কে
১৮৮৬ সালে এঙ্গেলস ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান শিরোনামে একটি দর্শন সংশ্লিষ্ট পুস্তক প্রকাশ করেন। উক্ বইয়ে তিনি হেগেল ও ফয়েরবাখ সম্পর্কে আলোচনা করেন। সেখানে তিনি ফয়েরবাখ নিয়েই বেশি আলোচনা করেন। ফয়েরবাখ বলেছিলেন, প্রকৃতি ও মানুষের বাইরে কোনোকিছুই নেই। ধর্মকে তিনি ‘আমাদের নিজেদেরই কল্পনামাত্র’ বলেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, মানুষে মানুষে প্রীতিমূলক সম্পর্ক, হৃদয়ভিত্তিক সম্পর্কিই ধর্ম।তিনি তার দর্শনে ‘প্রীতির সম্পর্ক’র সাহায্যে মানবজাতির মুক্তির আশা করেছিলেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে আলোচনার সময় এঙ্গেলস ধর্ম ও তার সামাজিক দিক নিয়ে আলোচনার অবতারণা করেন।
এঙ্গেলস বলেন, অত্যন্ত আদিম যুগে মানুষের নিজের প্রকৃতি ও তার পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি বিষয়ে ভ্রান্ত ও আদিম ধারণা থেকে ধর্মের উৎপত্তি।
এরপর তিনি ধর্মকে ‘ভাবাদর্শ’ বিবেচনা করে বলছেন- কিন্তু এই ‘ধর্মীয়’ ভাবাদর্শের একবার উদ্ভব হবার পর তা চলতি ধারণা-সামগ্রীর সঙ্গে সংগতি রেখে বিকশিত হয় এবং সেগুলিকে আরো বিকশিত করে।এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন ধর্মীয় অনুভূতি নিজেই হল সামাজিক সৃষ্টি এবং তাকে সমাজ ব্যবস্থা বা সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশ থেকে আলাদা করা যায় না, বরং তা সামাজিক সম্পর্কসমূহের যোগফল। ধর্ম একবার প্রতিষ্ঠিত হবার পরে তা ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। এবং এই ঐতিহ্যের রক্ষণশীল উপাদান থাকে যার রূপান্তর ঘটে শ্রেনীসম্পর্ককে বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে উপজীব্য করে।
তিনি উক্ত লেখায় বলছেন, বিভিন্ন শাসকশ্রেনী নিজেরা নিজেদের ধর্মকে বিশ্বাস করেন কি করেন না তাতে কিছুই যায় আসে না, কিন্তু তারা ধর্মকে নিজের শ্রেনীস্বার্থের উপযোগী করে ব্যবহার করে থাকে।
ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান বইয়ের শেষের দিকে পরিশিষ্ট অংশে এঙ্গেলস কার্ল মার্কসের ফয়েরবাখ সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত আকারে লিখিত ১১টি থিসিস সংযুক্ত করেন। থিসিসের ১১তম থিসিসে মার্কসবাদী মতবাদের সেই সর্ববহুল ব্যবহৃত বাক্যটি রয়েছে যাতে লেখা রয়েছে- এ যাবৎকালে দার্শনিকরা কেবল নানাভাবে জগতকে ব্যাখ্যাই করেছেন; কিন্তু আসল কথা হলো জগতকে পরিবর্তন করা।(The philosophers have only interpreted the world in various ways; the point is to change it.)
জার্মান পার্টিতে ভুল দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সংগ্রাম
জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে ফলমার তৎকালীন সরকারের নীতিকে শ্রমিকদের স্বার্থের অনুকূল বলে পার্টির এক সমাবেশে মত ব্যক্ত করেন।এই মত ব্যক্ত করে তিনি ‘ক্রমিক শান্তিপূর্ণ বিকাশ’ বা বৈধ উপায়ে ধীর রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনের দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করেন। বিপরীতে এঙ্গেলস বলেন, বুর্জোয়া সম্প্রদায় স্বেচ্ছায় কখনো ক্ষমতা ত্যাগ করবে না। এছাড়া তিনি বলেন, যেখানে জনগণের অধিকাংশ বিপ্লবকে সমর্থন জানাবে, জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকবে সেখানে বা সেই দেশেই কেবল শান্তিপূর্ণ উপায়ে পুরোনো সমাজের নতুন রূপান্তর সম্ভব।
এছাড়া এঙ্গেলস বামপন্থী নৈরাজ্যবাদের ভুল পন্থা বিষয়ে পার্টিকে সতর্ক করে দেন।১৮৯৩-৯৪ সালের দিকে জার্মানীতে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নির্বাচনে ব্যাপক সফলতা পায়। বামপন্থী অংশটি বৈধ এই উপায় ব্যবহারের পক্ষে ছিল না।
এঙ্গেলস বামপন্থা ও ডানপন্থা এই দুই ভুল দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে সতর্ক করে বলেন যে, বৈধকাজ সংগঠনের শক্তি কেড়ে নিচ্ছে। অথচ বৈধতার আমলেই আমাদের মাংসপেশী শক্তিশালী হচ্ছে, আমাদের গালে রং ধরেছে, মনেহচ্ছে আমরা যেন অনন্তজীবন লাভ করেছি।কিন্তু এমন একদিন আসবে যখন শাসকশ্রেনী নিজেরই তৈরী করা বুর্জোয়া নিয়মকানুন লংঘন করবে এবং শ্রমিক শ্রেনী ও তার পার্টির বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের আশ্রয় নেবে; তাদের পক্ষে এই মারাত্মক বৈধতাকে নিজের থেকে ভেঙে ফেলা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। এরপর তিনি বলেন, ঠিক এই মুহূর্তে আইন মেনে চলে ভালোই হয়েছে। কিন্তু আইন না ভেঙেও পার্টির পক্ষে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হবে না।(ফ্রান্সে শ্রেনী সংগ্রাম পুস্তকের ১৮৯৫ সংস্করণে এঙ্গেলসের ভুমিকা অংশ থেকে উক্ত বক্তব্য নেয়া হয়েছে।)
তিনি ক্ষমতা দখলের জন্য শান্তিপূর্ণ ও হিংসাত্মক এবং বৈধ ও অবৈধ সকল রূপ ব্যবহার করার কথা বলেন।

৭৪ বছর বয়সে জীবনাবসান
১৮৯৫ সালের ৫ আগস্ট রাত ১০.০০টায় ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে এক উইলের মাধ্যমে তিনি তার প্রকাশিত পুস্তকসমূহ ও তার স্বত্ব, প্রকাশিত পুস্তক থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও সঞ্চিত নগদ অর্থ তিনি জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নামে উৎসর্গ করেন।
এঙ্গেলস জ্ঞানী ছিলেন তো বটেই। এছাড়া তিনি জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন তাও সত্য। কিন্তু তার পাশাপাশি এই ছয়ফুট লম্বা ব্যক্তিটির ব্যক্তিত্বের নানারূপও আমাদের কিছুটা হলেও আলোচনা করা দরকার বলে মনে করছি। তাই নিচে এ বিষয়ে কিছুটা তুলে ধরা হলো।

বিভিন্ন ভাষা জানতেন এঙ্গেলস
এডওয়ার্ড এভেলিং এঙ্গেলসের মৃত্যুতে লিখিত স্মৃতিকথা লেখেন, ‘এঙ্গেলস এদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের নিজস্ব মাতৃভাষায় আলাপ করতে পারতেন। মার্কসের মতো তিনিও জার্মান, ফরাসি আর ইংরেজি নিখুঁতভাবে বলতে আর লিখতে পারতেন আর প্রায় অতটাই নিখুঁতভাবে লিখতে-বলতে পারতেন ইতালিয়ান, স্প্যানিশ আর ডেনিশ ভাষা রাশিয়ান, পোলিশ ও রুমানিয়ান ভাষা পড়তে পারতেন ও কাজ চালিয়ে দিতে পারতেন ওগুলিতে। এছাড়া লাতিন ও গ্রীক ভাষা নাই-বা বললুম।’পোল লাফার্গ এঙ্গেলস স্মৃতিকথায় লিখেছেন- দেশান্তরী কমিউন-সংগঠকদের একজন ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘এঙ্গেলস তো গোটা বিশেক ভাষায় তোতলান।’ উত্তেজিত হলে এঙ্গেলস একটু তোতলিয়ে কথা বলতেন।

এঙ্গেলসের কাছে প্রবঞ্চনা ক্ষমার অযোগ্য
১৮৯০ সালের এঙ্গেলসের ৭০ বছরের জন্মদিনকে স্মরণ করে মার্কস কন্যা এলিওনর মার্কস এভলিং লিখেছেন- একটি জিনিসকে এঙ্গেলস কখনও ক্ষমা করতে পারেননি আর তা হল প্রবঞ্চনা। যে লোক নিজেকে ঠকায় এবং আরো বেশি ঠকায় পার্টিকে, এঙ্গেলসের কাছে সে লোকের ক্ষমা নেই। তার কাছে এ জিনিস হল ক্ষমার অযোগ্য পা্প।

তিনি পার্টিতে মনখুলে কথা বলতেন
এঙ্গেলস সহজ সরল ও আন্তরিকভাবে সকলের সাথে মিশতেন। তাকে যে কেউ যে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি সংক্ষিপ্তভাবে,নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে উত্তর দিতেন। লোকে পছন্দ করুক আর না করুক তিনি তার মনের কথা অকপটে খুলে বলতেন।
ফ্রিড্রিক লেসনার নামক একজন শ্রমিক এ্ঙ্গেলসকে স্মরণ করে এক লেখায় বলছেন- পার্টির মধ্যে যখনই এঙ্গেলসের পক্ষে আপত্তিকর কোনো কিছুর উদ্ভব ঘটত, সঙ্গে সঙ্গে নির্দ্বিধায় তিনি তার অপছন্দের কথা প্রকাশ করতেন। দোদুল্যমানতা বা আপস করা তার স্বভাবে ছিল না।

সবসময় পরিপাটি থাকতেন তিনি
পোল লাফার্গ তার এঙ্গেলস স্মৃতি প্রবন্ধে লিখেছেন- “নিজের চেহারা ও সাজপোশাক সম্বন্ধেও তিনি একই রকম যত্নবান ছিলেন। সবসময়েই ফিটফাট আর নিখুঁত পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। প্রুশিয়ার সেনাবাহিনীতে একবছরের ঐচ্ছিক শিক্ষানবিশির সময়ে যেমন থাকতেন সব সময়ে মনে হত বিুঝি কুচকাওয়াজে যাওয়ার জন্যে সেরকম তৈরী হয়েই আছেন তিনি। এমন আর একজনের কথাও আমি জানি না যিনি জামাকাপড় ইস্ত্রি নষ্ট না করে কিংবা ব্যবহারে জীর্ণ করে না ফেলে তার মত অত দীর্ঘদিন একই পোশাক ব্যবহার করতে পারেন।”

হিসেবি ছিলেন কিন্তু কমরেডদের সাহায্য করতেন অকৃত্রিমভাবে
পোল লাফার্গ লিখছেন- “ব্যক্তিগত চাহিদার ক্ষেত্রে তিনি কিন্তু ছিলেন বিশেষ হিসেবি, একান্ত প্রয়োজন বোধ করলে তবেই সে-চাহিদা মেটানোর জন্যে খরচখরচা করতেন অথচ পার্টি ও পার্টি কমরেডরা প্রয়োজনে তার কাছে সাহায্য চাইলে তার বদান্যতার পরিসীমা থাকত না।”

তার ঘৃণা ও ক্রোধ ছিল মঙ্গলের জন্য
এডওয়ার্ড অ্যাভেলিং লিখছেন- চমৎকারভাবে ঘৃণাও করতে জানতেন এঙ্গেলস। বস্তুত, আন্তরিকভাবে ভালবাসতে জানেন এমন প্রতিটি ব্যক্তি যেমন ঘৃণা দেখাতে পারেন, এঙ্গেলসও পারতেন ঠিক তেমনটিই।যখন মনে করতেন অন্যায় কোনো ব্যাপার ঘটেছে তখন ক্রোধে ফেটে পড়তেন চরমভাবে আর সাধারণত তার এই ক্রোধ প্রকাশের ফলে মানুষের ক্ষতি না হয়ে বরং উপকারই হতো।

আন্তরিক অতিথিবৎসল ছিলেন তিনি
পোল লাফার্গের রচনা থেকেই উদ্ধতি দিচ্ছি- “তরুণদের সংসর্গের প্রতি আর্ষণ কোনোদিনই নষ্ট হয়নি এঙ্গেলসের, সর্বদাই তিনি ছিলেন আদর্শ অতিথিবৎসল গৃহস্বামী। রবিবার তার আতিথ্যে ভরা টেবিলের চারপাশে এসে হাজির হয়ে যেতেন লন্ডনের সমাজতন্ত্রী, যাতায়াতের পথে ওমুক বা তমুক কমরেড ও সকল দেশ থেকে আগত দেশান্তরীদের অনেকেই। আর সন্ধেগুলো আনন্দে কাটিয়ে এঙ্গেলসের বাড়ি থেকে খুশি হয়ে ফিরে যেতেন তারা হৈ-হুল্লোড়, রসিকতা আর অফুরান হাসিখুশিতে ভরা যে সন্ধেগুলোর প্রাণস্বরূপ ছিলেন এ্ঙ্গেলস স্বয়ং।”

সহায়ক তথ্যসূত্র
০১. https://en.wikipedia.org/wiki/Friedrich_Engels
০২. http://www.egs.edu/library/friedrich-engels/biography/
০৩. https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1895/misc/engels-bio.htm
০৪. http://spartacus-educational.com/TUengels.htm
০৫. http://www.workers.org/cm/bio.html
0৬. http://socialistreview.org.uk/tags/friedrich-engels
০৭. http://isreview.org/issue/65/marx-and-engelsand-darwin
০৮. http://pubs.socialistreviewindex.org.uk/isj65/german.htm
০৯. http://links.org.au/node/1218
১০. https://www.marxists.org/archive/jackson-ta/pamphlets/engels.htm
১১. http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1447947/
১২. http://www.bbc.com/news/uk-england-manchester-30375063
১৩. http://www.indepthinfo.com/communist-manifesto/engels.shtml
১৪. ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব, হায়দার আকবর খান রনো, তরফদার প্রকাশনী।
১৫. মার্কস এঙ্গেলস স্মৃতি, অনুবাদ: মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, বোধি প্রকাশন।
১৬. কীর্তিময় এক বন্ধুত্ব, শেখর দত্ত, বিপ্লবীদের কথা প্রকাশনা।
১৭. ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, ইয়েভগেনিয়া স্টেপানোভা, অনুবাদ সম্পাদনা: জাকির শামীম, নালন্দা প্রকাশনা।
১৮. কমিউনিস্ট ইশতেহার, মার্কস এঙ্গেলস।
১৯. এঙ্গেলসের এ্যান্টিডুরিং-সরদার ফজলুল করিম; বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
২০. কার্ল মার্কস ফ্রেডারিক এঙ্গেলস রচনা সংকলন (৪ খন্ড), ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড।
২১. কার্ল মার্কর জীবনী- ইয়েভগেনিয়া স্তেপানোভা; ন্যাশনাল বুক এজন্সি প্রাইভেট লিমিটেড।
২২. মার্কস-এঙ্গেলস: যোদ্ধা ও সংগঠক (১৮৪৩-১৮৫২)-সংস্কৃতি, সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সংখ্যা।
২৩. কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-আব্দুর রউফ চৌধুরী; অঙ্কুর প্রকাশনী।
২৪. এঙ্গেলস ভিজিট টু আয়ারল্যান্ড ইন ১৯৫৬, মার্কস এঙ্গেলস কালেক্টেড ওয়ার্কস, ভলিউম-৪০,পৃষ্ঠা-৪৯।
২৫. মার্ক্সিস্ট.কম-দ্য ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল: ১৫০ ইয়ার্স অন।

সর্বাধিক পঠিত

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষাঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসংগ-১৯৪৭ সাল

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষা তারিখঃ ১৬ আগস্ট, ২০১৭ ইতিহাস একটি জাতি বা জাতিসত্তা তথা জাতিসমষ্টিকে নানাভাবে প্রভাবিত কর...