Tuesday, December 27, 2016

মিঠুন চাকমার বিরুদ্ধে কেন চাঁদাবাজি মামলা?

২২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ইং আমার বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ি থানায় মামলা করা হয়েছে। মামলার ধারা হল ৩৪২/৩৮৫/৫০৬/৩৪ পেনাল কোড। অভিযোগ হল চাাঁদাবাজির। এমনিতেই রয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ধারাসহ মোট ১৩টি মামলা। এই মামলাগুলোর জন্য কোর্ট হাজিরা দিতে হচ্ছে মাসে ১০ থেকে ১২ দিন। অর্থাৎ শুক্র ও শনিবার এই দুই ছুটির দিন বাদে প্রায় প্রত্যেকদিন আমাকে কোর্র বারান্দায় থাকতে হয়! ডিসেম্বর মাসে কোর্টে ছিলাম ৪, ৬, ৭, ৮, ১৩, ১৪, ১৯ ও ২১ ডিসেম্বর। মাসটি এখনো শেষ হয়নি। আরো কয়েকদিন কোর্ট হাজিরার ডেট রয়েছে। কিন্তু কী এক ‘শনির দশা’ বা ‘বদ নসিব’ পেয়ে বসেছে যে, আরো মামলায় জেরবার হতে হচ্ছে?? কারাগার বা জেলখানা যেন ডাকছে!!
কেন এই মামলা?
শেষ কোর্ট হাজিরা ছিল ২১ তারিখ। তার আগের দিন খাগড়াছড়িতে সাংবাদিকরা একটি মানববন্ধন করেছে। প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক নীরব চৌধূরীকে মারধর করার প্রতিবাদে এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছিল। এলাকার একজন সচেতন ব্যক্তি হিসেবে এই ঘটনা আমাকে নাড়া দিয়েছিল। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে মাঝে মাঝে একটি ব্যক্তিভিত্তিক নিউজ ওয়েবসাইটে লেখালেখির কারণে আমাকে কেউ কেউ ‘সাংবাদিক’ হিসেবে পরিচিতি দিতেও সহায়তা করে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেকে ফ্রিল্যান্স সংবাদ প্রচারক হিসেবে পরিচয় দিতে রাজি থাকলেও থাকতে পারি!
সে যাই হোক, আন্তরিকতার দাবি রেখে এই প্রোগ্রামে প্রথমে দূর থেকে অংশ নিয়েছিলাম। পরে কিছুক্ষণের জন্য মানববন্ধনে দাঁড়িয়েও ছিলাম। দাঁড়িয়ে যা দেখেছি সে বিষয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে যা বলেছিলাম তা নিচে তুলে ধরছি-
আজ ২০ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির সাংবাদিকদের উদ্যোগে ফটো সাংবাদিক নীরব চৌধুরীর উপর হামলার প্রতিবাদে সাংবাদিকরা যে কর্মসূচি তাতে ছিলাম। এ বিষয়ে আমার এক বন্ধু বললো, দোস্ত, তোমাকেও সেই প্রোগ্রামে দেখলাম, ব্যাপার কী? আমি বললাম, ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে তাতে জোরজবরদস্তি ও অন্যায় রয়েছে, তাই সেখানে ছিলাম। সাংবাদিক নীরব চৌধুরী অন্যায্য কিছু করলে সে বিষয়ে আইনী পদক্ষেপ নেয়া যেত নিশ্চয়ই। এছাড়া বললাম, পৌর মেয়র রফিক সাহেব যদি সাংবাদিক মেরে থাকেন তবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে যা করেছেন তা তিনি সঠিক কাজ করেছেন বলে মনে হয় না। এভাবে যত্রতত্র অনাবশ্যক হ্স্তক্ষেপে তার ক্যারিয়েরই বরং ক্ষতি হবে। তিনি পৌর মেয়রের চেয়ে বড় কিছু হতে পারবেন না। তবে প্রোগ্রামে সরাসরি থেকে যা অবাক করেছে তা হল, সাংবাদিকদদের বিপরীতে পাল্টা প্রোগ্রাম ডেকেছিল পৌর মেয়রের সমর্থকরা। বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করার মত হলেও *রাজনৈতিক* রূপ দিয়ে মিছিল পাল্টা মিছিল একটু বেখাপ্পাই লাগে!!! মাথায় *রাজনীতি* ঢুকলে যা হয় আরকি!! সে যা হোক অনেকদিন পরে খাগড়াছড়ির *মাঠ* গরম দেখে এই শীত উপলভ্য বোধ হয়েছে!!!!


সাংবাদিকদের মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীদের একজন হিসেবে 


তারপরের দিন আরো মন্তব্য করেছিলাম -
যা বলা দরকার সাংবাদিক নীরব চৌধুরীর উপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল ২০ ডিসেম্বর সাংবাদিকরা মানববন্ধ করেছে। উক্ত কর্মসূচিতে কেন আমি উপস্থিত ছিলাম তার কথা গতকালকে ফেবু স্ট্যাটাসে বলেছি। গতকালকের কর্মসূচি নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদন দেখার পরে আরো কিছু বলা দরকার মনে করছি। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘দিদার কসাই’এর নেতৃত্বে মেয়র রফিক গ্রুপের ৪০/৫০ জন মিছিল করেছে। উক্ত মিছিলে শ্লোগান দেয়া হয়েছে- ‘একটি-দুটি সাংবাদিক ধর, ধরে ধরে জবাই কর; সাংবাদিকদের আস্তানা-জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’। তবে আমি বলতে চাই যে, প্রোগ্রামে সরাসরি থেকে আমি এই শ্লোগানগুলো শুনিনি। তারা যে শ্লোগানগুলো দিয়েছে তার মধ্যে আমি যেগেুলো শুনেছি সেগুলো হল- চাঁদাবাজদের গালে গালে জুতা মারো তালে তালে। চাঁদাবাজদের কালো হাত ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও উন্নয়নে বাধা দিলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।
(এক সাংবাদিকের নাম ধরে শ্লোগান দেয়া হয়েছে) ... চোরের গালে গালে জুতা মারো তালে তালে এছাড়া তাদের হাতে লাঠিসোঁটা ছিল কিনা তাও খেয়াল করিনি। তবে ’কসাই’ দিদারের নেতৃত্বে যে মিছিল হয়েছে, তাদের যে অঙ্গভঙ্গি তা অবশ্যেই ‘উস্কানিমূলক’ ‘আক্রমণাত্মক’ ছিল তা বলা যেতে পারে।
প্রথম আলোর মতো একটি স্বনামধন্য/বস্তুনিষ্ঠতার দাবিদার পত্রিকায় যখন কোনকিছু লেখা হয়, তখন তা গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই। তাই প্রথম আলো তাদের প্রতিবেদনে বস্তুনিষ্ঠতা দেখাবে তার আশা, প্রথম আলোকে কেউ পছন্দ না করলেও, সকল পাঠক অন্তত কিছুটা করে থাকে। প্রথম আলোর ভুমিকা যেন ‘অতিরঞ্জনাত্মক’ না হয় সে আশা রইল
তারপর ২৫ ডিসেম্বর আরেকটি স্ট্যাটাসে বলি-
আমার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে শোনার পর এক শুভাকাঙ্ক্ষী বললেন, মেয়র রফিকের *হাত* কতো লম্বা তুমি জানো না। আমি শুনে স্তম্ভিত! আমার নামে মামলা হবার সাথে মেয়র রফিকের *হাত* কত লম্বা-এর সম্পর্ক কি তা বুঝলাম না!?? তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে এই *প্রেডিকশন* *মিথ্যা* হবে এমন নাও হতে পারে!! এই কদিন খাগড়াছড়ি পৌর মেয়র রফিকের সাংবাদিক *পিটানো* নিয়ে *সরব* থাকার কারনে *মামলা* যে দেয়া হয়নি তাও বা কী করে বলি!?? অথবা জেল থেকে মুক্তি পাবার পরে এখন খাগড়াছড়ি সদরে *মুক্ত মানুষের মত* ঘোরাফেরা করতে পারায় *কেউ না কেউ* *শংকিত* এই ধারণা মিথ্যা নাও হতে পারে!! সে যাহোক,....!


২২ ডিসেম্বর যেদিনের ঘটনার জন্য চাঁদাবাজি মামলা দেয়া হয়েছে সেদিন পিসিপি খাগড়াছড়ি কলেজ শাখার কাউন্সিলে আমন্ত্রিত একজন অতিথি হিসেবে আমি মিঠুন চাকমা বক্তব্য দিচ্ছি


খাগড়াছড়িতে সাংবাদিককে মারধর করার ঘটনা নিয়ে সোচ্চার থাকার জন্যই সম্ভবত আমার নামে মামলা দেয়া হয়েছে! মামলা যে দেয়া হয়েছে তা জানতে পারি ২৫ ডিসেম্বর। শুভাকাঙ্খীরা আমাকে বললো কিছুদিন বাইরে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা না করতে। কিন্তু খুব মনেকষ্টের সাথে বলতে হচ্ছে আমার এই প্রাণপ্রিয় খাগড়াছড়িতে কিছুক্ষণ আলো হাওয়া বাতাস গায়ে লাগিয়ে না আসলে কেমন যেন মন আনচান করে!
আসলে পাহাড়ের সাধারণ জীবনযাপন এবং রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক চিন্তা এতবেশি সংকীর্ণভাবে সবার মনে ‘বিরাজ করে’ যে এখানে একজন ইউপিডিএফ সদস্য যখন মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করে তখন কারো কারো যেন মাথ্যাব্যথা সৃষ্টির কারণ হয়ে থাকে!
ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে সেই বৃত্ত থেকে মুক্ত মনে করলেও যেন তা-ই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে!!!
ইচ্ছে ছিল খাগড়াছড়ি শহরে সবার সাথে মিশে একটা নতুন কিছু করার উদ্যোগ নেব যেন এই ....
এই ফেসুবক নেটা একিটু খাপছাড়ভাবেই লিখছি!
যে মামলা দেয়া হয়েছে আইনজীবির সাথে পরামর্শ করে তা আইনীভাবেই মোকাবেলা করব। আদালত জেলে পাঠায় তাতেও রাজি!
যারা মামলা দিয়েছে তাদের তো অন্তত ‘সুখবোধ’ সৃষ্টি হবে!
আর নিশ্চয়ই নিজেকে ‘নিরপরাধ’ প্রমাণ করে আবার অনলাইন ফেসবুকে আসেতে পারব এই প্রত্যাশাই থাকল!
লেখালেখির জন্য ৫৭ ধারায় মামলা হবার পর ‘সন্তুষ্টি’ ‘আত্মতৃপ্তি’ ছিল, যাই হোক, অন্তত লেখালেখির জন্য তো মামলায় অভিযু্ক্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলাম!
কিন্তু এখন ‘চাঁদাবাজি’ মামলার আসামী হিসেবে নিজেকে দেখতে পেয়ে নিজেকে বেমানানই লাগছে!
তবে তারপরেও এটা তো জানা যে, রাজনীতিতে ‘মামলায়’ জেরবার হওয়া স্বাভাবিক একটি প্রবণতা মাত্র!

Sunday, December 4, 2016

ফিডেল ক্যাস্ট্রো- যিনি তাঁর মৃত্যুর পরও বিপ্লবের পতাকা উচ্চে তুলে ধরবেন!

ফিডেল ক্যাস্ট্রোর ছবির পাশে লেখা রয়েছে-
তিনি অসম্ভবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, এবং বিজয় অর্জন করেছেন

তারিখ: ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬
[মূলত, জানতে চাওয়াকে আরো ভালোভাবে আত্মস্থকরণের জন্যই  আমার লেখাসমূহের অবতারণা।  ক্যাস্ট্রোকে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। লেখায় হয়তো তথ্য দেয়া হয়েছে, অথবা কোথাও আবেগের আতিশয্যের কারণের তার বিপ্লবী জীবনের বস্তুগত ভিত্তিকে ভালভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। অথবা তাঁকে যারা শত্রুশিবিরের অন্তর্ভূক্ত করেছেন তারা তাঁকে অতিমাত্রায় চিত্রিত করেছেন,  এবং যারা তাঁকে ভালবেসেছেন তারা তাঁকে নিয়ে স্তুতি রচনা করেছেন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, তাঁকে আরো নানাভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার, কেননা, তিনি বিশ্ববাসীর এমন এক সম্পদ, তিনি এমন এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব যাকে নিয়ে আমরা যে কেউই আলোচনা করি না কেন, আমরা তাঁর কাছ থেকে গুণাবলীসমূহ বা যোগ্যতা বা দক্ষতাসমূহ শিখতে চেষ্টা করতে পারব অবশ্যই। এবং তাঁকে নিয়ে এই পর্যালোচনা আমাদের সবার জন্য, রাজনীতিবিদদের জন্য, সমাজ নেতৃত্বের জন্য, সংস্কৃতিমনাদের জন্য, পরিবর্তনের আকাংখা লালনকারীদের জন্য অব্শ্যই শিক্ষণীয় ফলপ্রসূ কিছু এনে দেবে বলেই প্রতীয়মান। সুতরাং তাকে নিয়ে  এই লেখা হলো সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে।  লেখায় দুর্বলতা থাকুক, কিন্তু তা থেকে আমরা নিজেকে বা নিজেদের কিছুটা তুলনাত্মক বিচার করতে পারব এই প্রত্যাশা রইল। ধন্যবাদ]

নতুন কিউবা গঠনের কারিগর ক্যাস্ট্রো
পুঁজিবাদের মোড়ল আমেরিকা বা ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’র মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরে জন্ম নিয়েছিল একটি কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের। ৪৪২১৮ বর্গমাইল আয়তনের সেই নতুন রাষ্ট্রের জন্মকালীন ধাত্রীর ভুমিকা যিনি নিয়েছিলেন তিনি হলেন ফিডেল ক্যাস্ট্রো। একনামে নিশ্চয়ই আমরা তাকে সবাই চিনি! ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট তিনি জন্মেছিলেন। এবং প্রায় নব্বই নছর ধরে এই ধরামর্ত্যে জীবন কাটিয়ে তিনি চলে গেলেন গত ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ইং কিউবা’র স্থানীয় সময় রাত ১০.০০ টায়(বাংলাদেশ সময় শনিবার সকাল নয়টায়)।
ফিডেল ক্যাস্ট্রোর পোশাকী নাম ফিডেল আলেসান্দ্রো ক্যাস্ট্রো রুজ। পিতার নাম এনজেল ক্যাস্ট্রো, যাঁর মূল শেকড় ছিল স্পেনের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় গ্যালিসিয়া নামক এলাকায়। যেভাবে অন্য অনেকেই এসেছিল সেভাবে ঠিক তিনিও এসেছিলেন কিউবায় কোন অনির্দিষ্ট এক কারণে। এরপর তিনি বাগান মালিক হয়ে নব্য ধনী হয়ে উঠেন। তারপর তিনি লিনা রুজ গনজালেজ নামে এক নারীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এবং এই নারীর গর্ভে  জন্ম নেয়া সাত সন্তানের মধ্যে একজন হিসেবে এনজেল ক্যাস্ট্রোর ঔরসে জন্ম নেন ফিডেল ক্যাস্ট্রো। জন্মস্থান কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় ওরিয়েন্ট প্রভিন্সের বিরান নামক এলাকা।
ছয় বছর বয়সে ফিডেল ক্যাস্ট্রোকে কিউবার শান্তিয়েগোতে লেখাপড়া শিখতে পাঠানো হয়। এরপর হাভানার একটি কলেজে তিনি ১৯৪৫ সালের দিকে ভর্তি হন। এসময় তিনি লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ দেয়ার চেয়ে খেলাধুলায় সময় কাটানোর দিকে বেশি সময় দেন। এরপর হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে তিনি রাজনীতিতে দীক্ষা নিতে থাকেন। প্রথম দিকে তিনি ছিলেন রাজনীতি সম্পর্কে অসচেতন ’অজ্ঞ’ একজন ব্যক্তি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই ’অজ্ঞ’ ব্যক্তি পুরো বিশ্বের রাজনীতিতে জীবনের শেষ পর্যন্তও এবং মরণের পরেও আরো অনেক বছর বা কাল ধরে নিশ্চয়ই জ্ঞানকান্ডসহ বাস্তব রাজনীতির দিকনির্দেশক হিসেবে থাকবেন এটা ধরেই নেয়া যায়!
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ’সততা-শিষ্টতা ও ন্যায়পরায়নতা’ এই শ্লোগানকে ভিত্তি করে ছাত্র সংসদ নির্বাচেনে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং পরাজয় বরণ করেছিলেন।  তিনি সান্তিয়াগোর  একটি মিশনারী স্কুলে লেখাপড়া করেন। স্কুলে থাকার সময় তিনি দুর্দান্ত রকমের দুষ্টুমি করতেন।  ছাত্রাবস্থায় প্রথম জীবনে তিনি খেলোয়ার হতে চেয়েছিলেন।  ১৯৪৫ সালে তিনি যখন হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তখন তার বয়স ছিল ১৯ বছর।  লম্বায় ছয় ফুট।   বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় তিনি একবার কিউবার আরো ৩ হাজার জনের একটি দলের সাথে যোগ দিয়ে ডোমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরশাসক ট্রুডিলোকে হটিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টায় অংশ নেন। কিন্তু তারা বোটে করে ডোমিনিকান রিপাবলিকে যাবার সময় কিউবার পুলিশ তাদের ধরে ফেলে।  ক্যাস্ট্রো নৌকা থেকে ঝাঁপিয়ে পরে সাঁতার কেটে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। 
বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলোযার টীমে নিগ্রোদের অংশগ্রহণের দাবি জানিয়ে  যে আন্দোলন হয় তাতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। 
১৯৪৮ সালের ১২ অক্টোবর তিনি মার্থা দিয়ার বালাট নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেন। তবে ১৯৫৫ সালের দিকে তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়।  এরই মধ্যে তাকে কয়েকবার জেলে যেতে হয়।  ১৯৫০ সালে তিনি আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। 
১৯৫৯ সালে যখন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাতিস্তা সরকারকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম হন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর।
বিপ্লবের কেন্দ্রভূমি সিয়েরা মায়েস্ট্রা পর্বতে ফিডেল ক্যাস্ট্রো


কিউবার বিপ্লবী রূপান্তরের প্রথম ধাপ
কিউবায় ১৪৯২ সালের অক্টোবর মাসে কলম্বাস তার জাহাজ নিয়ে আসেন। কিউবাকে দেখে তিনি অভিভূত হন। তিনি কিউবাকে মানুষের চোখে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে মনোরম ভূমি বলে মন্তব্য করেন। এই কিউবায় তেল বা কয়লা নেই। তবে সম্পদ হিসেবে রয়েছে লোহ ও নিকেল। 
বিপ্লবের আগে কিউবা ছিল গরীব একটি দেশ। দেশটির কৃষি সম্পদের ৭১ ভাগ ছিল মাত্র ৭ ভাগ মানুষের দখলে। এবং পুরো দেশের চাষযোগ্য জমির অর্ধেক অংশে তখন আখ চাষ করা হত। কিউবা ছিল তখন স্প্যানিশ কলোনী। আমেরিকা তার কাছের এই স্প্যানিশ কলোনীকে একবার মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে স্পেনের কাছ থেকে কেনার প্রস্তাব দেয়। তবে স্পেন সে প্রস্তাব মেনে নেয়নি। কিন্তু আমেরিকা রাষ্ট্রের শাসকরা এই কিউবাকে রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক মাধ্যকর্ষন সূত্র অনুসারে আপেলের সাথে তুলনা করতেন। তারা মনে করতেন এই কিউবা স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকার দিকে চলে আসবে। কিন্তু দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে কিউবার বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সরকার আমেরিকার এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নাকচ করে দিয়েছে। বরঞ্চ এখন কিউবা মাধ্যাকর্ষণের সূত্র অনুযায়ী আমেরিকার বিপরীত মেরুতেই অবস্থান করছে! 
কিউবার জনগণ ১৮৮৬ সালে একবার স্পেনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে। প্রায় ১০ বছর ধরে এই সংগ্রাম চলে। প্রায় ৮০ হাজার স্প্যানিশ সৈন্য নিহত হবার বিনিময়ে কিউবা স্প্যানিশ কলোনী হিসেবে থেকে যায়। ১৮৯৮ সালের দিকে কিউবা স্পেনের বিরুদ্ধে যখন লড়াই করছিল তখন আমেরিকা কিউবাকে নিউটনের মাধ্যাকর্ষসূত্রের ’আপেল’ হিসেবে বিবেচনা করে যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। আমেরিকার কংগ্রেস ১৯ এপ্রিল এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, স্পেনকে কিউবা থেকে তার সামরিক উপস্থিতি সরিয়ে নিতে হবে। কিউবাকে স্বাধীন দেশ হিসেবে এতে বিবেচনা করা হয়। এবং স্পেনকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করা হবে বলে কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৯৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে এক চুক্তির মাধ্যমে কিউবাকে স্বাধীনতা প্রদানের কথা বলা হয়। ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ স্প্যানিশ সৈন্য কিউবা থেকে চলে যায়। কিন্তু সাথে সাথে আমেরিকার সৈন্যবাহিনীর প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিউবায় আমেরিকার সেনা উপস্থিতি ও প্রভাব পাকাপাকি করার জন্য আমেরিকা কিউবার সংবিধানে এক সংশোধনী বা আইন যুক্ত করে যা প্ল্যাট আ্যামেন্ডমেন্ট নামে পরিচিত। ১৮৯৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকা কিউবায় রাজনৈতিক  ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে কিউবাকে নিয়ন্ত্রণ করতো। আমেরিকার ব্যবসায়ীরাই তখন কিউবার অর্থনীতির প্রায় সকলকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন।  ১৯৩৪ সালে কিউবায় আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত ও সমর্থিত বাতিস্তা ক্ষমতায় আরোহণ করে। ১৯৫২ সালের ১ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। কিন্তু বাতিস্তা সেই নির্বাচনের আগেই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সেনাবাহিনীকে নিজের করায়ত্তে নিয়ে ক্ষমতা সংহত করে। 
বাতিস্তার এই ক্যুদেতার বিরুদ্ধে ২৫ বছরের যুবক ক্যাস্ট্রো আদালতে গিয়ে বাতিস্তার বিরুদ্ধে কোড অব সোশ্যাল রুলস ভঙ্গে অভিযোগ তোলেন এবং জোর দিয়ে বলেন আইন ভঙ্গের জন্য বাতিস্তাকে ১০৮ বছর সাজা দেয়া দরকার। ক্যাস্ট্রো তখন মাত্র দুই বছর হলো হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের উপর ডিগ্রি নিয়েছেন। সাধারণ এক যুবক ক্যাস্ট্রোর এই আইনী যুক্তি খাটলো না। আদালত নীরবতা পালন করলো। কিন্তু এদিকে ক্যাস্ট্রো এই উপলব্ধিতে এলো যে, বিপ্লব ছাড়া এই স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি একবছর ধরে ২০০ জন পুরুষ ও সাথে আরো দুইজন নারীকে নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের নিয়ে সশস্ত্রভাবে লড়াই করার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। এবং ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই তিনি শান্তিয়াগোতে অবস্থিত এক হাজার সৈন্যের মোনকাডা ঘাঁটিতে হামলা চালালেন। ক্যাস্ট্রো ধরা পড়লেন এবং আর প্রায় সবাই নিহত হলেন। বাতিস্তা সরকার এই বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী ও তাদের সমর্থকদের উপর নির্মম নিপীড়ন চালালো। ব্যর্থ হয়ে গেল প্রথমবারে এই সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। 
ক্যাস্ট্রোকে আদালতে প্রশ্ন করা হলো, বেসামরিকভাবে আন্দোলনের পথ তিনি কেন নেননি? জবাবে খুব সোজাভাবে তিনি বললেন যে, কিউবায় এটাই সত্য যে এখানে কোন ধরণের স্বাধীনতা নেই। গত ১০ মার্চ থেকে কেউই কোন কথা বলতে পারছে না। আমি বাতিস্তা সরকারকে আদালতে দাঁড় করিয়েছিলাম। কিন্তু আদালত তা আমলে নেয়নি। 
এরপর এই অভ্যুত্থানের বিচার চলাকালীন ক্যাস্ট্রোকে আদালতে আনা হয়নি। ক্যাস্ট্রো তার একজন সহযোগীকে দিয়ে আদালতের কাছে একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তিনি আদালতে তাকে উপস্থিত থাকার এবং নিজের কাজের পক্ষে কথা বলার সুযোগ করে দিতে বলেন। তিনি এই চিঠিতে লেখেন- আমি রাষ্ট্রের পৌরুষদীপ্ত ভূমিকা আশা করছি। এছাড়া তিনি বলেন, ’আমার দিক থেকে, আমার পুরো জীবনে যদি আমাকে আমার অধিকার ও মর্যাদার এক কণাও বিসর্জন দিতে হয়, তবে আমি শত হাজার বার তা বিসর্জন দিতে সচেষ্ট থাকব।’ তিনি এরপর জোর দিয়ে এই উদ্ধৃতি প্রদান করেন- ’অন্ধকার গভীর গুহায় আটকে পড়া যৌক্তিক ন্যায়নীতি একটি সৈন্যবাহিনীর চেয়েও বেশি কিছু করতে পারে।’
”For my part, if for my life I have to cede an iota of my right or of my honor, I prefer to lose it a thousand times: "A just principle from the depth of a cave can do more than an army."
পরে অক্টোবরের দিকে তাকে ্আরেকবার কোর্টে হাজির করা হয়। এ সময় তিনি কথা বলার সুযোগ পান। তিনি একনাগাড়ে ৫ ঘন্টা আলোচনার সময় তিনি বিপ্লবের সপক্ষে কথা বলেন, কথা বলেন কিউবার জনগণের পক্ষে, তারা সশস্ত্রভাবে সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে যাবার পরে সেখানে তারা প্রথমে সৈন্যদের অত্যাচারী শাসকের পক্ষ ছেড়ে আসার জন্য আহ্বান জানান, কিউবার জনগণের অর্থনৈতিক বঞ্চনা-দৈন্যদশা ইত্যাদির কথা তিনি তুলে ধরেন। তিনি তার বক্তব্যে বিপ্লবের পক্ষে কথা বলেন। এই বক্তবের এক অংশে তিনি বলেন, ’শহীদ যারা হয়েছেন তাদের কবর হলো আমাদের সময়ের সবচেয়ে নৈবেদ্য দেয়ার সবচেয়ে সুন্দর বেদী। যখন আমাদের পিতৃভূমির কোলে কেউ মারা যায়, তখন মৃত্যুর সমাপ্তি ঘটে, কারাগারের দেয়াল শেষপর্যন্ত ভেঙে যায়, এবং মৃত্যুর শেষে জীবনের শুরু হয়।’ মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তাঁর এই দৃপ্ত ঘোষনায় বোঝা যায় তিনি কারাগারের প্রকোষ্ঠে বন্দী থেকেও স্বপ্ন দেখেছেন জীবনের, সংগ্রামের, একটি বিপ্লবের। 
”For the graves of the martyrs are the most beautiful altars of our day. When one dies In the arms of a grateful fatherland Death ends, prison walls breakFinally, with death, life begins.”
তিনি কিউবার সংবিধানের ৪০ ধারার উল্লেখ করে বলেন, প্রতিরোধ করার অধিকার সংবিধানে রয়েছে। সুতরাং আমাদের এই প্রতিরোধ সংগ্রাম সংবিধান সম্মত। তিনি আদালতকে বলেন, মহামান্য আদালত সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিদ্রোহ করার অধিকারকে যেকোন মতবাদ, আদর্শ ও বিধানে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তিনি তার বক্তব্যে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষনা, ফ্রান্সের মানুষের অধিকার শীর্ষক ঘোষনাসহ বিভিন্ন দার্শনিকের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। তিনি এ সকল উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, যখন কোন শাসক অত্যাচারী হয়, যখন শাসক জনগণকে ন্যায়ানুগভাবে শাসন করে না, তখন অত্যাচারী শাসককে সরিয়ে দেয়ার অধিকার সাধারণ জনগণের রয়েছে। 

আদালত ক্যাস্ট্রোকে ১৫ বছরের কারাদন্ড প্রদান করে। ক্যাস্ট্রোকেআটকের দুই বছর পরে বাতিস্তা সরকার জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য এবং নিজেকে জনগণের কল্যাণের সরকার প্রমাণের জন্য আটক রাজবন্দীদের মুক্তির ব্যবস্থা নেয়।
এ সময় ক্যাস্ট্রো ও তার সহযোদ্ধাদের মুক্তি দেয়া হবে এই কথা জানাজানি হয়ে যায়। ক্যাস্ট্রোও তা জেনে যান। এ নিয়ে তিনিতার এক আইনজীবি বন্ধুকে জেল থেকে লেখেন, আমরা আমাদের মুক্তির বিনিময়ে আমাদের এক কণাও মর্যাদা ভুলুন্ঠিত হতে দেব না। বিশ মাস জেলে থাকার পরেও আমরা এখনো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এবং সেই প্রথম দিনের মতো এখনো আমরা অবিচল। আমরা কোন অমর্যাদার খাতিরে কোন ধরণের ক্ষমা ঘোষনা গ্রহণ করতে চাই না। 
”Thus, we shall not yield one atom of our honor in exchange for our freedom.... After twenty months we are as firm and unmoved as on the first day. We do not want an amnesty at the price of dishonor.” 
তবে তারপরেও ১৯৫৫ সালের ১৫ মে ক্যাস্ট্রো ও তার সহযোদ্ধাদের মুক্তি দেয়া হয়। এদিকে এই দুই বছরে মধ্যে ক্যাস্ট্রো ও তার সহযোদ্ধাদের ২৬ জুলাই আন্দোলনের ঘটনা সারা কিউবায় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়। কিউবায় ক্যাস্ট্রো বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। এদিকে সে বছরের জুলাই মাসে ফিডেল ক্যাস্ট্রো মেক্সিকো চলে গেলেন। সেখানে তিনি কর্ণেল আলবার্টো বাইয়ো নামে ৬৩ বছরের এক কিউবানকে পেলেন। তিনি গেরিলা যুদ্ধসহ আফ্রিকান মুরদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের পক্ষে যুদ্ধ করেন, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে তিনি ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ক্যাস্ট্রো যখন তার সাথে সাক্ষাত লাভ করেন তখন তিনি মেক্সিকোতে ফার্নিচারের দোকান খুলেছেন। কর্ণেল মেক্সিকোর জঙ্গলে ৮২ জনের একটি দলকে তিন মাসের কঠোর প্রশিক্ষণ প্রদান করলেন। 
কিন্তু এরই মধ্যে ক্যাস্ট্রো একবার অস্ত্রসহ মেক্সিকান পুলিশদের হাতে ধরা পড়লেন। তাকে কারাগারে পাঠানো হলো। তাকে ২৩ দিন কারাগারে থাকতে হয়। 
কর্ণেল বাইয়ো তার শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ শেষে একথা বললেন যে, যুদ্ধের নিয়ম হলো শত্রুকে নিজের বিষয়ে গোপন রাখা, ধোকা দেয়া। কিন্তু তার বিপরীতে ক্যাস্ট্রো বললেন, তিনি চান কিউবার জনগণ জানুক যে তাদের এই সশস্ত্র দলটি কিউবার জনগণের জন্য লড়তে চায়। কারণ তখনো কিউবার ২৬ জুলাই আন্দোলন সারাদেমের জনগণের সমর্থন পেয়েছে। তিনি বললেন, আমি জানি সামরিকভাবে এটা ক্ষতিকর। কিন্তু এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও। 
ক্যাস্ট্রো তার ৮২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে গ্রানমা নামক নৌকায় উঠলেন এবং রওনা দিলেন কিউবার পশ্চিমে সান্তিয়াগোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথে তিনি আক্রমণের সম্মুখীন হলেন। এবং শেষ পর্যন্ত মাত্র ১২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে তিনি সিয়েরা মায়েস্ট্রা পাহাড় ঘেরা জঙ্গলে পৌঁছলেন। তাদের প্রত্যেকের হাতে একটি রাইফেল আর সাথে ১০টি গুলি মাত্র। সঙ্গে তাদের রয়েছে মাত্র কর্ণেল বায়োর তিনমাসের সামরিক প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা। আর যা রয়েছে তা হলো ক্যাস্ট্রোর মতো এক ক্ষ্যাপাটে বিপ্লবী। যিনি এই ১২ জন মাত্র বাহিনী দিয়ে লড়াইয়ে বিজয়ী হতে চান! এদিকে ক্যাস্ট্রোর বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতে বাতিস্তার ৩০ হাজার সৈনিক তখন সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত। তাদের হাতে রয়েছে সুসজ্জিত মেশিনগান, ট্যাংক, বিমান ও অন্যান্য সামরিক রসদ। 
কিন্তু তারপরেও ক্যাস্ট্রোর বাহিনী আস্থাশীল বিজয়ের প্রতি একমাত্র এই কারণে যে তারা একা ছিল না। পুরো কিউবায় তাদের সমর্থন ছিল । কারণ, জনগণ অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ছিল। 
ক্যাস্ট্রের দলটি সিয়েরা মায়েস্ট্রা পাহাড়ে সেখানকার জনগণকে লেখাপড়া শেখানোর স্কুল গড়ে তুললেন। মাত্র দুই বছরের মধ্যে তারা সেখানে  বিপ্লবী বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ৩০টি স্কুল প্রতিষ্ঠিত করলেন। সেখানে তারা কৃষি সংস্কার কার্যক্রম চালালেন। তারা সেখান থেকে কিউবা লিব্রে নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন ও তা বিপুলভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। ১৮৫৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সিয়েস্ট্রা মায়েস্ট্রা থেকে জধফরড় জবনবষফব বা বিপ্লবের রেডিও তাদের সম্প্রচার কার্যক্রম চালালো। পত্রিকার প্রচারণ, রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার ও নানামুখী জনসচেতনামূলক কাজের কারণে ক্যাস্ট্রোর দল জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পেলো। জনগণ বাতিস্তার প্রচার প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস না রেখে ক্যাস্ট্রোর বাহিনীর প্রচার প্রোপাগান্ডার উপর নির্ভরশীল হতে লাগল। 
১৯৫৮ সালের ১২ মার্চ ক্যাস্ট্রোর বাহিনী২৬ জুলাই আন্দোলনের পক্ষ থেকে জনগণের উদ্দেশ্যে একটি ম্যানিফেস্টো প্রচার করলেন। এতে সুনির্দিষ্টভাবে কর্মসূচি ঘোষনা করলেন এবং বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে সবদিক থেকে যুদ্ধ ঘোষনা করলেন। ম্যানিফেস্টোতে সরকারকে সে বছরের এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে ট্যাক্স না দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া বলা হয়, শীঘ্রই তারা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেবেন। বাতিস্তার বাহিনীকে আগামী সে বছরের ৫ এপ্রিলের মধ্যে বাতিস্তার মত অত্যাচারীকে ত্যাগ করে তাদের বাহিনীতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। আরো বলা হয়, রাউল ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে উত্তরে ওরিয়েন্টে প্রদেশে এবং মেজর জুয়ান আলমাইডের নেতৃত্বে পূর্বের দিকে সিয়েরা মায়েস্ট্রা থেকে বিপ্লবী বাহিনী লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, ক্যাস্ট্রোর বাহিনী এবার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। 
এবং বাতিস্তাও এই বাহিনীকে দমনে অগ্রসর হলো। মাত্র ৩০০ জনের গেরিলা দলকে দমন করতে ১২ হাজার সেনা জড়ো করা হলো। ক্যাস্ট্রোর ’মনস্তাত্ত্বিক’ যুদ্ধ চললো। ক্যাস্ট্রো তার বাহিনীকে দিয়ে কারোর উপর নিপীড়ন যেন চালানো না হয় তার কড়া ব্যবস্থা নিলেন। এছাড়া শত্রুপক্ষের সৈন্যবাহিনীর সদস্য যারা তাদের কাছে বন্দী হতো তাদের বিপ্লবে দীক্ষা দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হতো। এতে বাতিস্তার বাহিনীর মধ্যে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যেতে লাগল। 
১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে ক্রিস্টমাসের সময় ক্যাস্ট্রোর গেরিলা বাহিনি ওরিয়েন্টের শহর দখল করে নিল। সান্তিয়াগো দখলের কাছাকাছি চলে আসরো। গুয়ান্তামো দখলে চলে আসল। ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি সকালের দিকে ক্যাস্ট্রোর বাহিনী মোনকাডা দুর্গ দখল করতে সক্ষম হল এবং এর মাধ্যমে বাতিস্তার পতন হলো। 
 শুরু হলো কিউবা ও তার জনগণকে রূপান্তরের বিপ্লবী পদযাত্রা। 
১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে বিপ্লবের জয়লাভের পরে ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সরকার বৃহৎ পুঁজি জাতীয়করণসহ সমাজতান্ত্রিক গঠনকাজে হাতে হাত দেয়। কিউবা এই নবযাত্রায় প্রতিবেশী সাম্রাজ্যবাদী দেশ আমেরিকার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। আমেরিকা অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে। ১৯৬২ সালে জন এফ কেনেডি প্রথম সরকারীভাবে এই অবরোধের ঘোষনা দেন। এবং আজ ৬০ বছর অতিক্রান্ত হবার সময়েও সেই অবরোধ এখনো তুলে নেয়নি আমেরিকা।

ফিডেল ক্যাস্ট্রোর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ
১৯৬৩ সালে ৩৬ বছর বয়সে ফিডেল ক্যাস্ট্রো সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। সে বছরের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে তিনি সোভিয়েতে পৌঁছেন। তার সোভিয়েত যাত্রা খুব গোপনে সংঘটিত হয়। তিনি সোভিয়েতের মুরমানস্ক নামক শহরের উত্তর প্রান্ত থেকে তার সোভিয়েত যাত্রা শুরু করেন। এই শহরের পাশে সেভেরোদভিনস্ক নামক এলাকায় ছিল সোভিয়েতের সাবমেরিন ঘাঁটি। সেখানে তিনিই ছিলেন প্রথম বিদেশী যাকে মিসাইল সিস্টেম দেখানো হয়। 
মস্কোতে তিনি নিকিতা ক্রুশ্চেভের সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে সেখানে ছিলেন। তবে একবার তিনি রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ও নিরাপত্তা ফাঁকি দিয়ে সারারাত একা একা মস্কো ঘুরে বেড়ান। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে চেয়েছিলেন। 
একবার তিনি সাইবেরিয়ায় ভ্রমণের সময় সে এলাকার একটি ট্রেন স্টেশনে করাতিদের সাথে সাক্ষাত করেন। তাদের সাথে তিনি হঠাৎ দেখা করেন। তীব্র শীতের মধ্যে তিনি ট্রেনের কামরা থেকে একটি পাতলা গেঞ্জি গায়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। করাতি শ্রমিকরা তখন তৎক্ষণাৎ তাকে গরম কাপড় পরিয়ে দেয়। ক্যাস্ট্রো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তার ট্রাউজারের পকেটে থাকা তিনটি মাত্র সিগারেট তাদের দিতে সক্ষম হলেন। তিনটি সিগারেট পাওয়ার পরে শ্রমিকরা সিগারেটগুলো দিয়ে যা করলেন তা তাকে অবাক করে দিয়েছিল। শ্রমিকরা ক্যাস্ট্রোর কাছ থেকে সিগারেট তিনটি পাওয়ার পরে সেই সিগারেট কেউ একজন না নিয়ে তারা সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে প্রত্যেকে একবার মাত্র সিগারেটে টান দিয়ে সবাই যেন সিগারেটে একবার হলেও টান দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করলেন। ক্যাস্ট্রো সোভিয়েত শ্রমিকদের সমানভাবে এই ভাগ করে খাওয়া দেখে অভিভূত হন। পরে তিনি লেখেন- পশ্চিমে কেউই এমন আচরণ করেনি। যেই ব্যক্তি সিগারেট পেতো সে-ই তা পকেটস্থ করত। এখন আমি বুঝতে পারি রাশিয়ার জনগণের শক্তির উৎস কোথায় রয়েছে। 

“In the West, no one would have behaved that way. A person who got the cigars first would have pocketed them. Now I understand the strength behind the Russian people,” 
একবার লেনিনগ্রাদ(বর্তমান নাম সেন্ট পিটার্সবুর্গ) এ ক্যাস্ট্রো একটি মিটিঙে যোগ দেয়ার সময় একটি ছোট্ট মেয়ের কাছ থেকে ফুলের তোড়া পান। ক্যাস্ট্রো সেই ছোট্ট মেয়ের নামধাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করেন। এবং পরে তিনি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে সেই মেয়েটির সাথে দেখা করিয়ে দিতে বলেন। প্রথমে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ছোট্ট মেয়েটির সাথে দেখা করিয়ে দেয়নি। তবে পরে বার বার পীড়াপীড়ি করার কারণে তারা রাজি হয়। ছোট্ট মেয়েটি ছিল একটি অনাথ আশ্রমের ছাত্রী। কিন্তু সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ তাকে আরেকটি ভাল স্কুলে নিয়ে যায়। এবং ক্যাস্ট্রোকে সেখানে নিয়ে মেয়েটির সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেয়। ক্যাস্ট্রো মেয়েটির সাথে কথা বলেন এবং কথাসূত্রে ছোট্ট মেয়েটিকে তার ’স্কুল’ ঘুরিয়ে দেখাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু জবাবে মেয়েটি তাকে বলে যে, সে নিজেও স্কুলের কোথায় কী আছে জানে না, কারণ সে মাত্র দুইদিন হল সেই স্কুলে এসেছে। তাকে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ সেখানে এনেছিল। 
এই ঘটনা ঘটার পরে ক্যাস্ট্রো ভীষণ বিরক্তবোধ করেন। তিনি কর্তৃপক্ষের ’চটকদারিতা’র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, আপনারা আমাকে আকৃষ্ট করতে অনেক কিছু করতে পারেন। কিন্তু আমার তার প্রয়োজন নেই। 
সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক সিস্টেমে তখন আমলাতান্ত্রিকতা নিয়ন্ত্রণ এসে গেছে তা ক্যাস্ট্রোর এই অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারা যায়। এবং ক্যাস্ট্রো পরবর্তিতে নিশ্চয়ই সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকার সময় প্রাপ্ত এই অভিজ্ঞতাকে তার দেশের বিপ্লবী রূপান্তরের ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়েছেন বলে ধরে নেয়া যায়। 

আমরা সৈন্য পাঠাই না, আমরা ডাক্তার পাঠাই
২০০৯ সালে হাইতিতে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। কিউবা তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে ডাক্তার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠায়। এ বিষয়ে ক্যাস্ট্রো লিখেন- আমাদের দেশ পূর্ণ মনোযোগে মানবিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছে। যা আমাদের দ্বারা করা সম্ভব, আমরা আমাদের মানবিক ও বস্তুগত সহায়তা অব্যাহত রাখবো। আমাদের জনগণের ইচ্ছাশক্তি আরো দৃঢ়তা পাবে এবং তা আগামীতে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে কারণ আমাদের জনগণ তাদের ডাক্তার ও কর্মীদের নিয়ে গর্ববোধ করে, যারা তাদের সর্বোচ্চ দায়িত্ববোধ দেখাতে কার্পণ্য করে না। 
তাঁর লেখার শেষে তিনি জোর দিয়ে বলেন- আমরা ডাক্তার পাঠাই, সৈন্য নয়। 
Our country is accomplishing a strictly humanitarian mission.  To the extent that it is possible, it will contribute the human and material resources at its disposal.  The will of our people, who take pride in their medical doctors and workers who cooperate to provide vital services, is strong and will rise to the occasion.
কিউবায় ১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে ৭২৩ নাম্বার নামক একটি আইন জারি করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা গ্রামাঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই আইনে কোন ডাক্তারকে অবশ্যই এক বছরের জন্য কোন গ্রামে ডাক্তারীর কাজ করার বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয়।প্রথম ধাপে ৩৫৭ জন ডাক্তার স্বেচ্ছায় এমন গ্রামাঞ্চলে চলে যান যেখানে আগে কোন ডাক্তারই যায়নি। এছাড়া ডাক্তারকে অবশ্যই হাসপাতালে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করার বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়।  
কিউবা সরকার এটা বুঝেছিল যে, শুধুমাত্র আইন জারি করে বিপ্লবী পরিবর্তন সম্ভব নয়। এজন্য দরকার নানা ধরণের কার্যক্রমের ও উৎসাহ প্রদানমূলক ক্যাম্পেইনের। 
তারা ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে ১৬ দফা লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা চালায়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হল- শিশু মৃত্যু কমানো, বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন প্রদান, গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সংক্রামক এবং ছোঁয়াছে রোগের প্রতিকার, প্রতিরোধমূলক ঔষধ ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা। এই সকল লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করা হয় এবং ডাক্তারদের এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়। 
The consciousness of the 3,000 who stayed became the “material force” in the production of Cuban health care, as much a material force as the manufacture of pharmaceuticals or the construction of hospitals. 
বিগত ৬০ বছরে কিউবা বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০ হাজার চিকিৎসক প্রেরণ করেছে। এসকল চিকিৎসকের চিকিৎসা সেবা পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশের কোন না কোন জনগণ পেয়েছেন। 

কিউবার শিক্ষাব্যবস্থা
কিউবায় যখন বাতিস্তা সরকার ছিল তখন দেশের অধিকাংশ লোকজন ছিল নিরক্ষর। ক্যাস্ট্রো ক্ষমতা দখল করার পরেই হ্যাঁ, আমি পারি এই শ্লোগানকে ব্যবহার করে দেশব্যাপী স্বাক্ষরতা এবং একইসাথে শিক্ষিতের হার বাড়াতে উদ্যোগ নেন। লোকজনকে বিভিন্ন ব্রিগেডে সংগঠিত করে দেশব্যাপী এই শিক্ষাদান কার্যক্রম চলে। তারা হারিকেন হাতে এবং বই নিয়ে এই কার্যক্রম চালায়। ১৯৬১ সালের মধ্যে দেশে স্বাক্ষরতার হার ৯৮/৯৯ শতাংশে পৌঁছে যায়। কিউবায় শিক্ষা প্রদানের ধরণ ছিল একইসাথে পড়া, লেখা ও সুর করে কবিতার ঢঙে পাঠদানের ব্যবস্থা করা। 
স্কুলগুলো সকালে খোলে। ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে যাবার পরে তাদের সেখানে নাস্তার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর তাদের পাঠদান পর্ব শুরু হয়। দুপুরে আবার তাদের দুপুরের খাবার দেয়া হয় এবং আরো কয়েকঘন্টা পাঠদান করা হয়। শিশুরা দুপুর থেকে বিকালে স্কুলে নিজেদের মনমত খেলাধুলা বা খেলনা দিয়ে খেলা খেলে সময় কাটায়। যেসকল শিশু স্কুলে যেতে পারে না তাদের জন্য ভ্রাম্যমাণ শিক্ষকেরও ব্যবস্থা করা হয়, যারা ঘরে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া শেখায়। প্রাইমারী শিক্ষার কারিকুলামে রয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য নাচ, তাদের স্বাস্থ্য সচেতন করে তোলা, বাগান করা, কাঠে বা লোহায় খোদাই করা, বা সূচিকর্ম বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের শিক্ষা দেয়া ইত্যাদি। এছাড়া তাদের বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাস পড়ানো হয়। 
কিউবায় শিক্ষকগণকে এমনভাবে নির্বাচন করা হয় যেন তারা তাদের পেশার প্রতি অনুগত ও দায়বদ্ধ থাকেন। এক্ষেত্রে তারা কঠোর মান বজায় রাখেন। 
বিপ্লবের প্রথমেই কিউবা উচ্চশিক্ষার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত কার উদ্যোগ নেয়। হাজার শিক্ষার্থীকে রাজধানী হাভানায় নিঃখরচায় বসবাসের সুযোগ করে দেয়া হয়। এজন্য বহুতলা বিল্ডিঙগুলো ব্যবহার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে ইউনিভার্সালাইজড করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়।(“Universalization of the University.”)


কিউবায় প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সরকারী খরচে পড়ানো হয়। তবে একটি শর্ত থাকে তা হল লেখাপড়া শেখার পরে শিক্ষার্থীকে অবশ্যই তার নিজের জায়গায় গ্রামে যেতে হবে। 

বিকল্প মিডিয়া প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ
বিশ্বের বৃহৎ তথ্যমাধ্যম মিডিয়ার শতাংশই আমেরিকা ও ইউরোপ নিয়ন্ত্রণ করে। বলতে গেলে এই সকল সাম্রাজ্যবাদপন্থী মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা কৌশল দ্বারা বিশ্বের সকলেই নিয়নিন্ত্রত হয়ে থাকে। মিডিয়া আমাদের মাথায় যা ঢুকাতে চায় বা তার আমাদেরকে যেভাবে আবেগাক্রান্ত করতে চায় বা যেভাবে তারা আমাদের মানসিকতাকে গড়ে তুলতে চায় সেই সকল আমেরিকা-ইউরোপ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া আমাদেরকে সেভাবেই তথ্য দিয়ে থাকে। এবং আমরা অবচেতন এবং অসচেতনভাবেই এই বৃহৎ সাংস্কৃতিক আধিপত্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হই। ক্যাস্ট্রো কিউবায় সাংবাদিকদের সাথে এক বৈঠকে প্রথম লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষিতে বিকল্প মিডিয়া তৈরী করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী লাতিন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর আর্থিক সহায়তায় ২০০৫ সালের ২৪ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় ২৪ ঘন্টার স্প্যানশ ভাষার নিউজ চ্যানেল দক্ষিণের টেলিভিশন বা টেলিভিসোরো দেল সুর সংক্ষেপে টেলিসুর। এই টেলিভিশন লাতিন আমেরিকায় প্রতিরোধের চ্যানেল হিসেবে পরিচিতি পায়। 
কিউবার রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম গ্রানমাতে এ বিষয়ে এক মন্তব্যে বলা হয়- আমরা এখন থেকে আমাদের কন্ঠস্বরে আমাদের কথা শুনতে চাই। 

বিপ্লবী পার্টির করণীয় বিষয়ে ক্যাস্ট্রো
একটি বিপ্লবী পার্টিকে অবশ্যই তার ক্যাডার বা কর্মীদের শিক্ষাদানে দক্ষতা দেখাতে হবে। পরিমিতিবোধের সাথে কঠোর শৃংখলা ছাড়া এর কোন সহজ সমাধান নেই। আসুন আমরা আমাদেরকে তাদের থেকে রক্ষা করি বিশেষ করে যারা জনগণের নীতিবোধ এবং তাদের স্বপ্নকে ময়লা পানির মত ড্রেনে ফেলে দেয়। 
The education of the cadres will be the most important task to be mastered by the revolutionary parties. There will never be easy solutions; strictness and exigency must prevail. Let’s guard ourselves especially from those that throw down the drain the people’s principles and dreams together with the dirty water.
এছাড়া তিনি বলেন, পার্টি সদস্যকে অবশ্যই জটিল সমস্যা সমাধানে দক্ষ হতে হবে। যারা পার্টিতে রাজনৈতিক শিক্ষা প্রদান করবেন তাদের অবশ্যই ইতিহাস ও অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আমাদের সমাজে সবার দক্ষতা উন্নীতকরণ খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। 
শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শারীরিক পরিশ্রম করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হোসে মার্তির আদর্শও ছিল কাজ করা ও শিক্ষা অর্জন করা। 
আত্মমর্যাদাবোধ ও মূল্যবোধ গঠন ছাড়া আমাদের বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না, এবং কিউবা সবসময় এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে তাদের নীতিপন্থার অন্তর্ভূক্ত করেছিল। আমাদের দেশ মিথ্যাচার ও অপবাদের দ্বারা হয়রানীর বিরুদ্ধে এই বৈশিষ্ট্য অর্জন করে লড়াই করেছিল। মূল্যবোধের পাশাপাশি উন্নত সংস্কৃতি ও আত্মসচেতনাবোধ বিগত ৫০ বছরের প্রতিরোধকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিল। এবং এটি নেতা বা নেতাদের কোন বিশেষ বুদ্ধিবিবেচনামূলক গুণ ছিল না বরং, এটি ছিল মৌলিকভাবে দেশের জনগণের সবার।|
(This resistance would never have been possible without the dignity and ethics that have always characterized the policies of Cuba, a country harassed with revolting lies and slanders. Alongside ethics, a culture and conscience were built that made possible the feat of more than five decades of resistance. This was not a particular merit of its leaders but basically of its people. )
২০১২ সালে এক লেখায় তিনি বলেন, আমরা যা করেছি তার জন্য অমরা কখনোইা দুঃখপ্রকাশ করবো না। এটাই সত্য যে, পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাবার পরেও আমাদের মাথা এখনো আমরা উঁচুতে রাখতে পেরেছি। 
”We will never apologize to anyone for what we did. The fact is that half a century has gone by, and here we still are with our heads held high.”
ক্যাস্ট্রো কিউবার কম্যুনিস্ট পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে বললেন, শীঘ্রই আমিও অন্য সবার মতো হতে যাচ্ছি। আমাদের সবার জন্যই সেই (জীবনাবসানের) সময় ঘনিয়ে আসবে, কিন্তু কিউবার কম্যুনিজমের ধারণা উতরে যাবে আজীবন! 
লাতিন আমেরিকার ভূমিহীন কৃষকদের আন্দোলনে সক্রিয় এক নেতা ফিডেল ক্যাস্ট্রোর মৃত্যুর পরে লিখিত এক স্মারক বক্তব্যে বলেছেন-
তিনি সার্বক্ষণিকভাবে এবং প্রতিটি ক্ষণে তার জনগণের সাথে, যেকোন প্রতিকূলতায়, যুদ্ধে, উৎপাদন ও জ্ঞান সম্পর্কিত সাংগঠনিক কাজেকর্মে পাশাপাশি থেকেছেন। তিনি চেষ্টার কোন ত্রুটিই রাখেননি এবং উৎসর্গীকৃত এক দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন। 
( He was always with his people, every moment, on the front line, in all difficult situations: in war, in the organization of production and knowledge.  He spared no efforts and set an example of the spirit of sacrifice.)
ক্যাস্ট্রো তার ৯০ বছরের পুরো জীবনের মধ্যে ৭০ বছর কাটিয়েছেন রাজনৈতিক কাজে জড়িত থেকে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর জনগণের সত্যিকারের মুক্তির সুমহান কাজের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন। একটু ক্ষণের জন্যও তিনি নিশ্চয়ই তা থেকে বিচ্যুত হননি। 
তিনি কিউবা ও তার জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের চেতনাকে শানিত করেছেন। এবং একই সাথে তিনি ছিলেন বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বা নিপীড়িত মানুষের আদর্শিক এক নেতা। তাকে যখন আদালতে দাঁড় করানো হয় এবং নানা প্রশ্ন তাকে করা হয় তখন তিনি তার সহযোদ্ধা এক কমরেডকে স্মরণ করে বলেছিলেন যে, সেই ব্যক্তি মারা গেছে তাতে তেমন বিশেষ কিছু হয়নি! ব্যক্তি মারা যায় কিন্তু তার আদর্শ তো রয়ে যায়। 
 তাঁর মৃত্যুর পরে নিশ্চয়ই তিনি সেই আদর্শের বিপ্লবী পতাকা উঁচুতে তুলে ধরবেন! 

বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
“Hasta la Victoria Siempre!”


তথ্যসূত্রঃ 

12.   Cuba-Anatomy of A Revolution, Leo Huberman, Paul M. Sweezy, Monthly Review Press, New York 1960.
১৩. প্রতিরোধ প্রতিস্রোত লাতিন আমেরিকা, শান্তনু দে, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, জানুয়ারি, ২০০৯। 








Friday, December 2, 2016

জেনি ফন ভেস্টফালেন- সমাজ পরিবর্তনের দর্শন প্রতিষ্ঠার প্রধান অংশীদার এবং কার্ল মার্কসের সহধর্মিনী


তারিখঃ ২ ডিসেম্বর, ২০১৬
জেনি ফন ভেস্টফালেন বা জেনি মার্কস। তিনি কার্ল মার্কসের স্ত্রী হিসেবে পরিচিত। কার্ল মার্কসের সহধর্মিনী হিসেবে তিনিও সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী দর্শনকে তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রেখেছিলেন। প্রুশিয়ার অভিজাত পরিবারের সন্তান হিসেবে উত্তর জার্মানের সলসভেদেলে শহরে ১৮১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী তাঁর জন্ম। মৃত্যু হয় ১৮৮১ সালের ২ ডিসেম্বর। ৬৭ বছর পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন। সাত সন্তানের জননী হয়েছিলেন। কার্ল মার্কসকে বিয়ে করার পরে তাঁর নাম হয়ে যায় জেনি মার্কস। তাঁর পুরো নাম জোহানা বার্থা জুলিয়া জেনি ফন ভেস্টফালেন।

১৮১৬ সালের দিকে জেনি মার্কসের পিতা ট্রিয়ার শহরে চলে আসেন। সেখানে কার্ল মার্কসের পিতা ও জেনি ফন ভেস্টফালেনের পিতার মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। কার্ল মার্কস তখন ১৩ বছরের বালক।  সেই বয়সেওি তার চোখেমুখে ছিল বিদগ্ধতার ছাপ।  জেনি মার্কসের বাবা ব্যারন লুডভিগ ফন ভেস্টফালেন তাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোতেন। এসময় তিনি কার্ল মার্কসকে দান্তে, হোমার, গ্যেটে, শেকসপীয়ারে লেখা থেকে উদ্ধৃতি শোনাতেন। তাঁরা ইউরোপের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন। লুডভিগ ভেস্টফালেন কার্ল মার্কসকে ফ্রেঞ্চ ইউটোপীয়ান সমাজতান্ত্রিক সেইন্ট শিমনের লেখা পড়তে দিতেন। বস্তুত, কার্ল মার্কস যে সমাজ পরিবর্তনের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন তার মূলে ছিল জেনির পিতা লুডভিগ ফন ভেস্টফালেনের এই ভূমিকা। এবং কার্ল মার্কস যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডি থিসিস লেখেন তখন তিনি থিসিসের মুখবন্ধে ব্যারন লুডভিগ ভেস্টফালেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। জেনি মার্কসও তার পিতার উত্তরাধিকার বহন করেছেন। তিনিও ছিলেন বিদুষী মহিলা। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর জানাশোনা ও লেখাপড়া ছিল। তিনি একই সাথে ছিলেন আকর্ষনীয়া- ট্রিয়ার শহরে বহু যুবক তরুণের স্বপ্নসাথী। 
তবে হয়তো বা সেই সময়ের পরিস্থিতিতে ইউরোপের মত মুক্ত সমাজব্যবস্থার দেশেও কার্ল মার্কসের মত ভুমিকা জেনি মার্কস নিতে পারেননি। অথবা, কার্ল মার্কসকে  তার আরাধ্য কাজের সুযোগ করে দিয়ে তিনি শ্রমবন্টনের নিয়ম অনুযায়ী প্রধানত গৃহিণীর কাজে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। নতুবা তিনিও হতে পারতেন বিদুষী কোন লেখিকা অথবা নারী দার্শনিক!
 জেনি মার্কসের মত একজন নারীকে কার্ল মার্কস স্ত্রী হিসেবে পেয়েছিলেন বলেই হয়ত কার্ল মার্কস হতে পেরেছিলেন একজন সমাজ পরিবর্তনের পথপ্রদর্শক দার্শনিক ও বিপ্লবী! জেনি মার্কসের মেয়ে এলিনর মার্কস এভেলিং তার মা’কে স্মরণ করে লিখেছিলেন, স্ত্রী জেনী মার্কসের সহায়তা না পেলে কার্ল মার্কস কোন কিছুই করে যেতে পারতেন না।
আর কার্ল মার্কসও জেনি মার্কসকে ছাড়া ছিলেন যেন হালবিহীন বা পালবিহীন নৌকার মতো। ম্যারী গ্যাব্রিয়েল ’লাভ এন্ড ক্যাপিটাল: কার্ল এন্ড জেনী মার্কস এন্ড বার্থ অব এ রেভ্যলুশন’ বইয়ে কার্ল মার্কসের জীবনে জেনি মার্কসের অপরিহার্যতা সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছিলেন, ’ তিনি(জেনি মার্কস) কার্ল মার্কসের শুধুমাত্র একজন বন্ধু এবং প্রণয়ী বা প্রেমিকাই ছিলেন না। তাদের দু’জনের মধ্যে পরিণয় বন্ধনের ১৩ বছর আগে থেকেই জেনি মার্কস ছিলেন কার্ল মার্কসের বিশস্ত  বৌদ্ধিক আলোচনার সহসাথী। জেনি মার্কসকে ছাড়া কার্ল মার্কসের হৃদয় এবং বুদ্ধিজ্ঞানও কাজ করত না(Neither his heart nor his head functioned without her.) ) ।
জেনি মার্কসের সাথে কার্ল মার্কসের ছোটকাল থেকেই পরিচয় ছিল। জেনি মার্কসের ছোটভাই এডওয়ার্ড ফন ভেস্টফালেনের সাথে কার্ল মার্কসের বন্ধুত্ব ছিল। কার্ল মার্কস জেনী মার্কসের চেয়ে বয়সে ৪ বছরের ছোট ছিলেন। ১৮৪৩ সালের ১৯ জুন তারা দু’জন ট্রিয়ারের কাছে ক্রোয়েটসনাখ শহরে খ্রিস্টান বিবাহ রীতি অনুযায়ী বিয়ে করেন। এর আগে ১৮৩৬ সালের দিকে তারা গোপনে বাগদান সম্পন্ন করেন। ১৮৪৩ সালে যখন তাদের বিয়ে হয় তখন জেনি মার্কসের বয়স ছিল ২৯ বছর আর কার্ল মার্কসের বয়স ছিল ২৫ বছর। 
বিয়ের পরে তারা প্যারিসে চলে যান। সেখানে ১৮৪৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের প্রথম সন্তান জেনিচেন বা জেনী জন্ম নেন। পরে প্যারিস থেকে জেনি ট্রিয়ারে তার মায়ের কাছে চলে যান। সেখান থেকে তিনি কার্ল মার্কসকে কয়েকটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে দেখা যায় তিনি তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করছেন। ১৮৪৪ সালের ২১ জুন কার্ল মার্কসকে তিনি লেখেন- 
প্রিয়তম আমার, প্রায়ই আমি গভীরভাবে আমাদের কাছের এবং দূরের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। এবং এখন যেভাবে নিশ্চিন্ত হাসিখুশী জীবন কাটাচ্ছি তার জন্য আমাকে মূল্য দিতে হবে নিশ্চয়ই। সম্ভব হলে আমাকে এ বিষয়ে পরামর্শ দিও যেন আমি এভাবে চিন্তিত না হই। সবাই একটা নিশ্চিত আয়ের পথ খুঁজে নিতে বলে।  এসকল পরামর্শ শোনার পরে আমি একগাল হাসি দিয়ে বা গালে হাত দিয়ে বা পরনের কাপড় নেড়েচেড়ে বা মাথার টুপি নিয়ে খেলা করে বা চুল নাড়তে চাড়তে সাধারণ উত্তর দিয়ে যাই। কিন্তু এরপরে আমার বুকে যে ছটফটানি ধরে এবং ভবিষ্যত চিন্তা আমাকে যেভাবে উদ্বিগ্ন করে তা দেখার তো আর কেউ থাকে না। 
(Dearest heart, I am often greatly worried about our future, both that near at hand and later on, and I think I am going to be punished for my exuberance and cockiness here. If you can, do set my mind at rest about this. There is too much talk on all sides about a steady income. I reply then merely by means of my rosy cheeks, my clear skin, my velvet cloak, feather hat and smart coiffure. That has the best and deepest effect, and if as a result I become depressed, nobody sees it.)
তবে এরপরই তিনি একই চিঠিতে কার্ল মার্কসকে লেখালেখি বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি লেখেন-
 শুধুমাত্র বিদ্বেষাত্মক ও খিটখিটে টাইপে লেখালেখি করো না। তুমি জানো, তোমার লেখা কতটা পরিমাণে প্রভাবিত হয়ে থাকে। বস্ত যা তা-ই লিখো এবং গভীরে গিয়ে লিখো অথবা সরস হাল্কাচালে লেখার চেষ্টা করো।
 (Only don't write with too much rancour and irritation. You know how much more effect your other articles have had. Write either in a matter-of-fact and subtle way or humorously and lightly.)
 ১৮৪৪ সালের আগস্ট মাসে এঙ্গেলসের সাথে কার্ল মার্কসের দেখা হয় এবং তারা বুদ্ধিবৃত্তিক দার্শনিক আলোচনা চালিয়ে যান। পরে তাদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক বৌদ্ধিক বন্ধুত্ব ইতিহাসে অমর হয়ে যায়। এঙ্গেলসের সাথে আলাপ হবার পরে তারা দুইজনে মিলে জার্মানীর সাইলেসীয় তাঁতীদের সংগ্রামে ভুমিকা রাখেন। জার্মানীর সরকার এতে ক্ষুব্ধ হয় এবং কার্ল মার্কসকে প্যারিস থেকে বহিস্কার করতে ফ্রান্স সরকারকে অনুরোধ জানায়।  ১৮৪৫ সালের প্রথম দিকে কার্ল মার্কসকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্যারিস ছাড়তে বলে ফ্রান্স পুলিশ।
ফ্রান্স সরকার জেনী মার্কসকে আরো কিছুদিন থাকতে অনুমতি দেয়। পরে জেনি মার্কস ঘরের আসবাবপত্র সম্পত্তি সরঞ্জাম বিক্রি করে ব্রাসেলসে যাওয়ার টাকা সংগ্রহ করেন এবং ব্রাসেলসে কার্ল মার্কসের কাছে চলে যান। ব্রাসেলসে তারা চরম অর্থকষ্টে পড়েন। ১৮৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের দ্বিতীয় সন্তান লরা মার্কসের জন্ম হয়। 
১৮৪৬ সালে ব্রাসেলসে কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস কম্যুনিস্ট যোগাযোগ কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রীদের ভ্রান্ত দর্শনের বিরুদ্ধে লেখালেখি চালিয়ে যান। এসময় জেনী মার্কস কার্ল মার্কসের লেখালেখিতে সহায়তা করেন। তিনি কার্ল মার্কসের হিজিবিজি লেখাগুলো সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখে দিতেন। এছাড়া অন্য কাজেও তিনি মার্কসকে সহায়তা করতেন। 
পোল লাফার্গ তাঁর কার্ল মার্কস স্মরণে প্রবন্ধে সম্পর্কে লিখেছেন- কার্ল মার্কসের ”স্ত্রীর বুদ্ধিমত্তা ও ভালমন্দের বিচারবোধ সম্পর্কে এতখানি শ্রদ্ধা ছিল মার্কসের যে সকল পান্ডুলিপিই তিনি স্ত্রীকে দেখাতেন এবং তাঁর মতামতকে অপরিসীম মূল্য দিতেন। ১৮৬৬ সালে একথা তিনি নিজেই আমাকে বলেছিলেন। ছাপাখানায় পাঠানোর আগে স্বামীর পান্ডুলিপিগুলি শ্রীমতি মার্কস নিজের হাতে কপি করে দিতেন।
মদনমোহন গুহ তাঁর ’কার্ল মার্কসের জীবনে জেনি’ বইয়ে লেখেন- তাঁর(জেনি মার্কস) সময় কেটে যেতো মার্কসের লেখা প্রবন্ধগুলি কপি করতে করতে। তাতে তিনি আনন্দ পেতেন। পেতেন সান্ত¡না। তদুপরি প্রবন্ধগুলি কপি করতে গিয়ে সেগুলি তাঁর পড়া হয়ে যেতো। বেশ ভালভাবেই এরফলে বিশ্বের তদানীন্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল হবার সুযোগ পেতেন।(পৃ: ৫৯)
১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে তাদের তৃতীয় সন্তান এডগারের জন্ম হয়। তাদের এই সন্তান ১৯৫৫ সােেল ৮ বছর বয়সে মারা যান। 
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ৩ তারিখ প্রুশিয়া সরকারের অনুরোধে বেলজিয়াম সম্রাটের স্বাক্ষরে  কার্ল মার্কসকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্রাসেলস ছেড়ে যেতে বলা হয়। ব্রাসেলসের পুলিশ তাকে আটক করে পুলিশ হাজতে রেখে দেয়। জেনি মার্কস  থানায় তার খোঁজ নিতে গেলে পুলিশ তাকেও থানায় আটকে রাখে। পরদিন তাদের মুক্তি দেয়া হলেও তাদেরকে ৫ মার্চের মধ্যে ব্রাসেলস ছেড়ে প্যারিসে চলে যেতে হয়। যাবার সময় তারা কোন কিছুই নিয়ে যেতে পারেননি। জেনি মার্কস তাঁর এক স্মৃতিকথায় এ বিষয়ে লিখেন- চলে আসার সময় দিনটা ছিল ঠান্ডা, মেঘে-ঢাকা, বিরস আর বাচ্চাদের শরীর গরম রাখা শক্ত হয়ে পড়েছিল। এদিকে আমার কোলের বাচ্চার বয়স তখন মাত্র এক বছর। 
 প্যারিসে কিছুদিন থাকার পরে সেখানেও পুলিশ এসে তাদের প্যারিস ছাড়তে বলল। এরপর তারা চলে যান জাার্মানে। 
১৯৪৮(৪৯?) সালের মে মাসের দিকে জেনী ৪র্থ বারের মত অন্তঃস্বত্বা হন। বিপ্লবী কাজের জন্য জার্মান থেকে  কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলসকে বিতাড়িত হতে হলো। এবার আরকেবার কপর্দকশুন্য অবস্থায় জেনী মার্কসকে ঘর ছাড়তে হলো। তাকে গর্ভবতী সন্তানসহ আরো তিন সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিতে হলো ট্রিয়ারে তার মায়ের কাছে। চতুর্থ সন্তান হেনরী এডওয়ার্ড গুইডো ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে একবছর না হতেই তাদের এই সন্তান মারা যায়। 
১৮৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেনি মার্কস ও কার্ল মার্কস লন্ডনে আসেন। কয়েকদিন হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে থাকার পরে তারা সোহো নামক এলোকার ৬৪ নং ডিন স্ট্রীটের একটি বাড়িতে উঠেন। এসময় তাদের পরিবারে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কাল চলতে থাকে। 
১৮৫০ সালের ২০ মে জেনি মার্কস ফ্রাঙ্কফুর্টের জনৈক ভাইডেমারের কাছে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেন। এই চিঠিতে বোঝা যায় তারা কী নিদারুণ অর্থকষ্টে জীবন অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু তারপরেও জেনী মার্কস বিপ্লবকে বিসর্জন দেয়ার কথা চিন্তা করেননি। ভাইডেমায়ারের কাছে তিনি লেখেন- ’ ... কার্লের প্রাপ্য কিছু পারিশ্রমিক পেয়ে থাকলে কিংবা ভবিষ্যতে পেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা যেন আমাদের পাঠিয়ে দেন। টাকাটা আমাদের ভীষণ, ভী-ষ-ণ দরকার।’
আর্থিক অভাব অনটনের কথা লেখার পরে তিনি লেখেন- মনে করবেন না এইসব তুচ্ছ ছোটখাটো দুঃখ দুর্দশা, ভাবনা চিন্তা আমার মনোবল নষ্ট করে দিয়েছে। আমি খুব ভালো করেই জানি যে আমাদের সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার নয়। ...। সত্যি সত্যি যা আমার আত্মাকে কষ্ট দিচ্ছে এবং হৃদয়কে রক্তাক্ত করছে, তা হলো এই চিন্তা যে, ছোট খাটো ব্যাপারের জন্য আমার স্বামীকে কতোই না কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে, আমার পক্ষে কত সামান্য পরিমাণেই না তার সাহায্যে আসা সম্ভব হচ্ছে, এবং যিনি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে অসংখ্য লোকের উপকার করে এসেছেন, তিনি নিজে কত না অসহায়! কিন্তু তাই বলে, প্রিয় হের ভাইডেমার, ভুলেও এ কথা ভাববেন না যে, আমরা কারো কৃপাপ্রার্থী। (সূত্রঃ কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন, জাকির তালুকদার, পৃ:১০৩, ঐতিহ্য, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)
এ সময় তাদের সংসারের টানাটানি থাকলেও তাদের বাড়িতে যখন কেউ আসতেন তাদেরকে জেনি নিজের সাধ্যমত আপ্যায়ন করার চেষ্টা করতেন। পোল লাফার্গ তার কার্ল মার্কস স্মরণে প্রবন্ধে লিখেছেন- সকল দেশের বহু শ্রমিকই শ্রীমতি মার্কসের আতিথেয়তায় ধন্য হয়েছেন। 
সংসারের টানাটানি সামাল দিতে তিনি হল্যান্ডে মার্কসের মামা লিওন ফিলিপসের কাছে সহায়তা চান। কিন্তু ফিলিপস সহায়তা দেননি। এসময় তিনি খুব ভেঙে পড়েন। 
তাদের পঞ্চম সন্তানের নাম জেনি ইভালিন ফ্রান্সিস। ১৮৫১ সালের ২৮ মার্চ তার জন্ম হয়। ১৮৫২ সালের ১৪ এপ্রিল এক বছরের কিছু বেশি সময় বেঁচে থেকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।  
১৮৫৫ সালের ১৬ জানুয়ারি ৬ষ্ঠ সন্তান জেনি জুলিয়া এলিযেনর জন্মগ্রহণ করেন। ৭ম সন্তানটি ১৮৫৭ সালের ৬ জুলাই জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়। সেই সময়গুলোতে  অনেক সময় তারা তাদের পরিবারের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতে পারতেন না। পরে তার এক বান্ধবী লীনা শ্যোলা তার বাড়িতে আসেন। জেনির দুরবস্থা দেখে তিনি ব্যথিত হন এবং জেনিকে কিছু সহায়তা করেন। পরে ১৯৬০ সালে তারা আবার অর্থকষ্টে পড়েন। কার্ল মার্কস আমেরিকার ট্রিব্রিউন পত্রিকায় লেখালেখি করে যে আয় করতেন তা কমে যায়। ঠিক সেই সময়ে জেনি মার্কস বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। রোগের কারণে তার দুই চোখ নষ্ট হতে বসেছিল। 
অপরদিকে তার মেয়েদেরও বয়স বাড়ছিল। বয়সের সাথে সাথে তাদের নানা আনুষঙ্গিক খরচও বেড়ে যাচ্ছিল। অথচ সে অনুযায়ী আয় উপার্জন ছিল না। তবে ১৯৬৪ সালের দিকে কার্ল মার্কসের মামা/কাকা মারা গেলে তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু সম্পত্তি ও অর্থ পান। এ সময় তারা কিছুটা অনটন থেকে রক্ষা পান। একইসাথে এঙ্গেলসও ১৯৫০ থেকে তাদের পরিবারকে মাঝে মাঝে আর্থিক সহায়তা দিতেন। এভাবেই তাদের সংসার জীবন কেটে যাচ্ছিল। জেনি মার্কস বিচক্ষণতার সাথে এই সমস্যা মোকাবেলা করে আসছিলেন এবং কার্ল মার্কসের লেখালেখি ও রাজনৈতিক কাজ যেন থেমে না থাকে সেই চেষ্টা তিনি করে যাচ্ছিলেন। 
জেনি মার্কসের চার সন্তান খুব কম বয়সে মারা যায়। বাকি তিন কন্যা সন্তান যারা বেঁচে ছিলেন তারাও নানাভাবে সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। 
১৮৮১ সালের ২ ডিসেম্বর জেনী মার্কসের মৃত্যু হয়। ৫ ডিসেম্বর হাইগেট সমাধিক্ষেত্রে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। সমাধিক্ষেত্রে আইভি লতায় ঢাকা মার্বেল পাথরের উপর খোদাই করে জেনি ফন ভেস্টফালেনের নামের সাথে লেখা রয়েছে- কার্ল মার্কসের প্রিয়তমা পত্নী|(The Beloved Wife of Karl Marx).
 সমাধিক্ষেত্রে অন্ত্যেস্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে এঙ্গেলস জেনী মার্কস সম্পর্কে বলেছিলেন, ”এই মহিলা, তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা একইসাথে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, চরিত্রের মধ্যে ছিল উদ্যম এবং আবেগ, এবং সংগ্রামের ক্ষেত্রে তার সহযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর অপরিসীম উৎসর্গীকৃত মানসিকতার মাধ্যমে গত ৪০ বছরে যে অবদান রেখে গেছেন তা কোনকালেই জনগণের কাছে প্রকাশ পায়নি এবং সমসাময়িক কোন সংবাদ মাধ্যমে এই কীর্তি ঘোষিত হয়নি। এটা এমন যা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা অনুভব করেছি। 
কিন্তু এই একটি বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে, রিফিউজি কমিউনের স্ত্রীরা তাকে প্রায়ই স্মরণ করবে, আর বাকি আমরাা তার সাহসী ও প্রাজ্ঞ পরামর্শ অবশ্যই মিস করবো....। 
আমি এখানে তার গুণাবলীর কথা বলতে চাই, যা তার বন্ধুরা জানে এবং স্মরণে রাখবে, তা হল, অপরকে সুখী করে যিনি নিজে সুখী বোধ করেন, তিনি হলেন তাই।” 
(The contribution made by this woman, with such a sharp critical intelligence, with such political tact, a character of such energy and passion, with such dedication to her comrades in the struggle — her contribution to the movement over almost forty years has not become public knowledge; it is not inscribed in the annals of the contemporary press. It is something one must have experienced at first hand.

But of one thing I am sure: just as the wives of the Commune refugees will often remember her — so to, with the rest of us have occasion enough to miss her bold and wise advice, bold without ostentation, wise without ever compromising her honor to even the smallest degree. I need not speak of her personal qualities, her friends know them and will not forget them. If there ever was a woman whose greatest happiness was to make others happy it was this woman.)
তথ্যসূত্রঃ
৮. কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন, জাকির তালুকদার, পৃ:১০৩, ঐতিহ্য, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫।
৯. কীর্তিময় এক বন্ধুত্ব, শেখর দত্ত, বিপ্লবীদের কথা প্রকাশনা, নভেম্বর, ২০১৪।
১০. মার্কস এঙ্গেলস স্মৃতি, বোধি, বাংলাদেশ সংস্করণ, অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১১।
১১. কার্ল মার্কসের জীবনে জেনি, মদনমোহন গুহ, মিরান্দা পাবলিশার্স, পশ্চিমবঙ্গ বইমেলা, ২০০১।

Wednesday, November 30, 2016

প্যালেস্টাইনের জনগণের সংগ্রাম


মিঠুন চাকমা

ভূমিকা

১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, প্রতিবছরের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের পক্ষে সংহতি প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস পালন করা হবে। তারপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য পালন করা হয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও সাধারণভাবে এই দিবসটি পালন করা হয়।
আমাদের মনে হয়েছে, এই দিবসটি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার সাথে পালন না করে এই দিবসকে উপলক্ষ করে আমাদের এই লড়াইকে বোঝা জানা এবং নিপীড়িত জনগণের এই লড়াই থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের আন্দোলন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার আদায়কামী জনগণের অনেক কিছুই শেখার রয়েছে।
এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ফিলিস্তিনি জনগণ বা প্যালেস্টাইন অঞ্চলের জনগণের আন্দোলনের সাধারণ সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমরা নিচের আলোচনায় ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছি।
এই লেখাটিতে ফিলিস্তিনি জনগণের লড়াই সংগ্রামের সাধারণ বর্ণনা মাত্র দেয়া হয়েছে। সুতরাং, এই লেখা পড়ে আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের লড়াইকে সার্বিকভাবে বুঝতে পারবো না। তবে সাধারণ সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করে আমরা এই লড়াইয়ের মুখ্যদিকগুলো গোচরীভূত করার চেষ্টা করেছি।
এই সংক্ষিপ্ত লেখাটি পাঠকগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ



প্যালেস্টাইন ভূখন্ডের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভৌগোলিক কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্যালেস্টাইন অঞ্চল এশিয়া, ইউরোপ আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের সীমানা বিন্দুতে অবস্থিত। সংস্কৃতি-ধর্ম-অর্থনীতি রাজনীতিসহ নানাদিক থেকে এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে ক্রশরোড বা সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করেছে। এই অঞ্চলের কথা লেখা রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মে, ইসলাম ধর্মে ইহুদী ধর্মে। অনেক নবী-রাসূলগণ এই অঞ্চলে জন্মেছেন। এই সকল কারণে এই অঞ্চল বিশেষ তাপর্য নিয়ে দেখে থাকে ইসলাম-খ্রীস্টিয় ইহুদী ধর্মের শতকোটি জনগণ। একসময় এই অঞ্চলের নাম ছিলকানান খ্রীস্টপূর্ব ১১৫০-১২০০ শতকের সময় এই অঞ্চলটি মিশরের শাসনাধীন ছিল।  মূলত, ফিলিস্তিনী, ইহুদী আরব জাতি বা কালীন সময়ে এই সকল জাতিগোষ্ঠী বা গোষ্ঠীভক্ত জনগণ তখন এই এলাকায় বসবাস করত। খ্রীস্টপূর্ব ৭০০ শতকের সময় এই অঞ্চলটি এসিরিয়দের শাসনে চলে যায় এবং ফিলিস্তিনীয়রা তাদের রাজ্য হারিয়ে ফেলে। এরপর পার্সিয়ানরা অঞ্চলটি দখল করে। পরবর্তীতে রোমানরা অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তখন এই অঞ্চলটির নাম ছিল জুদাইয়া, এবং তখন ইহুদীরা সেখানে বসবাস করত। খ্রীস্টিয় ৬৬ থেকে ৭০ সালে ইহুদীরা রোমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করে। এই লড়াইয়ে প্রায় ১১ লাখ লোক মারা যায়। এছাড়া ১১৫-  খ্রীস্টাব্দে আরেকবার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ১৩২ তেকে ১৩৬ খ্রীস্টাব্দে সংঘটিত হয় বার-কোখবা যুদ্ধ। এতে ইহুদীরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় এবং সেখান থেকে তারা অনেকেই বিতাড়িত হয়ে চলে যায়। খ্রীস্টানদের প্রাধান্য রোমানদের বিজয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রীস্টিয় ৩০০ থেকে ৬৫০ অব্দ পর্যন্ত খ্রীস্টানরা উক্ত এলাকা শাসন করে। এরপর অঞ্চলটিতে মুসলিশ শাসকরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। মুসলিম শাসকরা শাসনক্ষমতায় আসার পরে ইহুদীরা আবার ফিরে আসে। খ্রীস্টিয় ১০০০ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিমরা অঞ্চলটি শাসন করতে সক্ষম হয়। এরপর খ্রীস্টান মুসলিমদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড শুরু হয়। ১২৫০ সাল পর্যন্ত তাদের মধ্যে যুদ্ধ চলে এবং কোনসময় খ্রীস্টানরা বিজয়ী হতে সক্ষম হলেও কোন কোন সময় মুসলিমরাও বিজয়ী হতে সক্ষম হয়। এরপরে তুর্কীরা ১৫ শতকের কিছুসময় তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এই শতশত বছর ধরে খ্রীস্টান-ইহুদী মুসলিমরা তাদের সবার জন্য পবিত্র শহর জেরুজালেম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা নিজেদের মতো করে গিয়েছিল। 
১৭ শতক থেকে বিশ শতক পর্যন্ত নানা উত্থান পতন ঘটতে থাকে এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শাসকদের মধ্যে। ১৭৯৮ থেকে ১৮০০ সালের দিকে নেপোলিয়ন এই অঞ্চলসহ জর্ডান এলাকা দখল করে। পরে তা আবার তুর্কীদের হাতে চলে যায়। তুর্কীরা দুর্বল হতে থাকে এবং ১৯১৬ সালের ১৬ মে ব্রিটেন ফ্রান্স সাইকস-পিকট চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুযায়ী ধরে নেয়া হয় যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে তুর্কী সাম্রাজ্য দুর্বল হবে এবং এই দুর্বলতার কারণে তুর্কী তার সাম্ররাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। ব্রিটেন ফ্রান্স এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে তুর্কীদের হৃত সাম্রাজ্যের কোন অঞ্চল কে দখলে নেবে তা নিয়ে যে চুক্তি করেছিল তা- ছিল সাইকস-পিকট চুক্তি। সে অনুযায়ী প্যালেস্টাইন অঞ্চল ব্রিটেনের হাতে চলে যায়। ১৯১৭ সালের শেষদিকে ব্রিটেন তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য থেকে প্যালেস্টাইনের গাজা-জেরুজালেমসহ বিভিন্ন এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়। 
বেলফোর ডিক্লারেশন
১৯১৭ সালের নভেম্বর ব্রিটেনের তখনকার ফরেন সেক্রেটারী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর জায়নবাদী/ইহুদীবাদী আন্দোলনের নেতা ব্যারন রথসচাইল্ডকে একটি চিঠি লিখলেন। এতে তিনি লেখেন, ’ সরকারের পক্ষ থেকে আমার একথাটি আপনাকে জানাতে বড়ই ভাল লাগছে যে, ইহুদীদের জায়নবাদী আকাঙ্খার প্রতি সহমর্মিতা স্বরূপ নিম্নোক্ত ঘোষনা ব্যক্ত করছে, যা একইসাথে মন্ত্রীপরিষদ বা কেবিনেটে উপস্থাপন অনুমোদন করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত চিঠিতে এরপর তিনি ইহুদী জনগণের জন্য প্যালেস্টাইনীয় অঞ্চলে একটি জাতীয় ভূখন্ড প্রদানের পক্ষে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুললেন
 ১৯১৯ সালে তিনি এক মেমোরেন্ডামে লিখলেন, ’ইহুদীবাদ সঠিক অথবা বেঠিক যাই হোক না কেন তার গুরুত্ব লাখ আরব জনগণের চেয়েও অধিক বেশি তখন প্যালেস্টাইনের জনসংখ্যা ছিল লাখ ৫০ হাজার। তার মধ্যে লাখই ছিল প্যালেস্টাইনীয়।   
১৯৩৬-৩৯ সালে আরব-প্যালেস্টাইনীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম
বেলফোর ডিক্লারেশনের পরে ইহুদীরা তাদের দেশ তৈরীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতে থাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ইহুদীরা প্যালেস্টাইন ভূখন্ডে আসতে থাকে। প্যালেস্টাইনীয় আরবরা ব্রিটেনের দখলদারিত্ব, ইহুদীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৩৬ সালের অক্টোবরের দিকে শহর এলাকায় ধর্মঘট প্রতিবাদী সমাবেশের ডাক দেয়। কালীন প্যালেস্টানীয় নেতা খলিল আল-সাকাকিনি অধিকার আদায়ের জন্যজীবন মরণের সংগ্রামেঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান। কিন্তু ব্রিটেন এই প্রতিবাদ প্রতিরোধ কঠোর হাতে দমন করে। পরে ১৯৩৭ সালের আরব প্যালেস্টাইনীয়রা সহিংসভাবে বিক্ষোভ সংঘটিত করতে থাকে। ব্রিটেনও সহিংসভাবে প্রতিবাদ দমনের উদ্যোগ নেয়। এই লড়াইয়ে হাজার আরব যোদ্ধা প্রাণ হারায়। ১০৮ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়

ফেদায়িন বা সর্গীকৃত আত্মত্যাগী বাহিনী

ষাট বছরের অধিক বয়সী ইসলামী চিন্তাবিদ শেখ ইজ্জেদদীন কাশাম। ১৯৩৫ সালের ১২ নভেম্বর ইহুদীদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ফেদায়িন বা সর্গীকৃত আত্মত্যাগী বাহিনী গঠনের আহ্বান জানান। তিনি হাজার খানেক তরুণ সদস্য সংগ্রহ করেন। তাদের দিয়ে তিনি আত্মঘাতী আক্রমণের সূচনা করেন।  এবং এক পর্যায়ে তিনি এক আক্রমণের শাহাদ বরণ করেন। তাঁর এই উদ্যোগের ফলে আরব প্যালেস্টাইনীদের মধ্যে জাগরণের ঢেউ ওঠে। তার আদর্শ আরবদের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মানসিকতার সৃষ্টি হয়

প্যালেস্টাইনীয়দের এই প্রাথমিক পর্যায়ের সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যায়। কিন্তু তারা তারপরেও থেমে থাকেনি। একইসাথে ইহুদীদের রাষ্ট্র ইসরাইল গঠনের পরতাও চলতে থাকে। 

ইহুদী জাতির উত্থান বা রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের আবির্ভাব
ইহুদী নামের জাতিগোষ্ঠীর জনগণের ধর্ম হচ্ছে েইহুদী ধর্ম। এই ধর্মের জন্মস্থান হিসেবে বর্তমান ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়। খ্রীস্টের জন্মের একহাজার বা তারও অধিক বছর আগে বর্তমান ফিলিস্তিন বা ইসরায়েলের কিছু এলাকায় ইহুদী জাতি বসবাস করতো বলে ইহুদী ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে। ইতিহাস মতে জানা যায় এই এলাকায় একসময়জুডাহরাজ্যের অস্তিত্ব ছিলো। এই জুডাহ রাজ্যের জনগণকেই ইহুদী জাতির পূর্বপুরুষ বলে অভিহিত করা হয়। তবে খ্রীস্টপূর্ব ৭শশতকের দিকে এই রাজ্য নয়া  এসিরিয় সাম্রাজ্য কর্তৃক পরাভূত হয়। ইহুদী জাতির লোকজনকে তাদের নিজ আবাসভূমি থেকে পালিয়ে যেতে হয়। হাজার বছরের ব্যবধানে তারা সারাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সাংস্কৃতিকভাবে তাদের ধর্মীয়  ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। এবং তারা নানা বিপদ আপদ মোকাবেলা করে নানা জায়গায় ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা পেশায় উন্নতি লাভ করতে থাকে। একসময় তারা অনুভব করতে থাকে যে, তাদের নিজস্ব আবাসভূমি থাকা প্রয়োজন। পৃথিবীর নানা জায়গায় নানাভাবে নিগৃহীত, নির্যাতিত হতে হতে তাদের মধ্যে এই বোধ জন্মায়। 

নিজস্ব আবাসভূমি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রথম বাস্তবকাজে হাত দেন থিওডোর হারাজেল নামে এক  ইহুদী। তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক। তিনি ফ্রান্সের এক প্রভাবশালী পত্রিকায় কাজ করতেন। তিনি ১৮৯৭ সালের দিকে সুইজারলান্ডের বাজেল নামক স্থানে ইহুদীদের নিয়ে এক সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে গঠন করা হয় দ্য ওয়ার্ল্ড জিউইশ অর্গানাইজেশান। তিনি এই সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে স্বীকৃত একটি ইহুদী জাতির দেশ গঠনের মাধ্যমেই ইহুদী জাতির দুরবস্থা দূর হতে পারে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি জনমত গঠন বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাহায্য লাভের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন। এছাড়া এই কাজকে এগিয়ে নিতে যে অর্থের প্রয়োজন তার সংস্থান করতে তিনি বিশ্বের বিভিন্নস্থানে অবস্থানরত ধনী ইহুদীদের কাছ থেকে ফান্ড সংগ্রহের জন্য প্রস্তাব করেন। তবে দেখা যায়, প্রথমদিকে ধনী বা প্রভাবশালী ইহুদী ব্যক্তিগণ তেমন সাহায্য করেনি। কিন্তু, সাধারণ ইহুদী জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহায়তা দিতে থাকে। 
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে পরে ইহুদী নেতৃবৃন্দ গোপনে নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। নিজেদের একটি দেশ গঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তারা ফিলিস্তিনের জেরুজালেম, তেল আবিব ইত্যাদি এলাকায় ব্যাপকভাবে ইহুদী জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের কাজ হাতে নেন। উক্ত এলাকা তার আশেপাশের এলাকাগুলো তখন অনুর্বর ছিলো। এই এলাকাগুলো বেশিরভাগই শহরে বা দূর অঞ্চলে বসবাসকারী জমিদার-ধনীদের মালিকানায় ছিলো। ইহুদীরা ছলে বলে কৌশলে এই এলাকার হাজার হাজার একর দাম দিয়ে জমিদার বা ধনীদের কাছ থেকে কিনে নিতো। এছাড়া সাধারণ স্থানীয় আরবদের কাছ থেকেও তারা জায়গাগুলা কিনে নিতো। আর অনেকের কাছ থেকে তারা জোর করে জায়গাগুলো দখলে  নিতো। এভাবে তারা বিরাট এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। 

তারপর তারা অগ্রসর হয় নিজেদের জন্য  একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার কাজে। তারা সংগৃহীত ফান্ডের মাধ্যমে এবং প্রভাবশালী ইহুদীদের মাধ্যমে তাদের নিজেদের জন্য একটি আবাসভূমি গঠনের সপক্ষে বিশ্বে প্রচারণা চালাতে থাকে। একইসাথে তারা নিজেদের জনবল অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান করতে থাকে। 
১৯৪৮ সালের ১৪ মে তারা স্বাধীন  ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেয়। 
আজ পর্যন্ত এই রাষ্ট্র নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে টিকে আছে এবং ভবিষ্যতে আরও অনেক বছর এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই প্রতীয়মান। 

প্যালেস্টাইনকে দুইভাগ করার জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৮১() নং সিদ্ধান্ত বা রেজ্যুলেশনের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন অঞ্চলকে দুইভাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। উক্ত সিদ্ধান্তে প্যালেস্টাইনের মোট ভূখন্ডের ৫৬.৪৭ ভাগ ইহুদী রাষ্ট্রের জন্য এবং বাকী ৪৩.৫৩ ভাগ আরব প্যালেস্টাইনীয়দের দেয়ার কথা বলা হয়। জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্ত আরবরা মানতে পারেনি। কিন্তু ইহুদীরা তা মেনে নেয় এবং এর ভিত্তিতে তাদের নিজেদের দেশ গঠন করতে তারা অগ্রসর হতে থাকে। 
জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মতে প্যালেস্টাইন ইসরাইল নামে দুইটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার কথা থাকলেও ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরাইল নামক একটি সেটলার স্টেট বা দেশ গঠিত হয়। এই রাষ্ট্রগঠনকে কেন্দ্র করে ইসরাইল-আরব যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইসরাইল তার পেশীশক্তি তথা সমরশক্তি প্রয়োগ করে ফিলিস্তিন ভূখন্ডের অনেক এলাকা নিজের করায়ত্তে নিয়ে নেয়। জেরুজালেম শহর বিশেষ আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত হবার কথা থাকলেও ইসরাইল এই শহরটিও দখল করে নেয়। এই শহরটি মূলত ইসলাম-খ্রীস্টান ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে এলাকা নিয়ে ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠন হবার কথা ছিল তার ২৬ শতাংশ এলাকাও ইসরাইল দখল করে নেয়। এসময় একদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ইহুদীরা বিপুল সংখ্যায় ইসরাইলে আসতে থাকে এবং অন্যদিকে সেই বছরেই প্রায় লাখ প্যালেস্টাইনী জনগণ নিজেদের জায়গাজমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। 
১৯৬৭ সালের জুন মাসে    থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত ইসরাইল আরবদের মধ্যে ৬দিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে ইসরাইল মিশর থেকে দখল করে গাজা স্ট্রীপ সিনাই উপত্যকা, জর্ডানকে পরাজিত করে  দখল করে নেয় পশ্চীম তীর পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নেয় গোলান মালভমি। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মিশর সিরিয়ার সাথে ইসরাইলের আবার যুদ্ধ হয়। ইসরাইল বিবদমান দুই পক্ষের সাথে দখলীকৃত ভুখন্ড নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করে

কারামে যুদ্ধে আত্মমর্যাদার লড়াই

১৯৬৮ সালের মার্চমাসে ইসরায়েল জর্ডানে ফিলিস্তিনিদের শরনার্থী অধ্যূষিত এলাকায় আক্রমণ চালায়। মার্চের ২১ তারিখ ইসরায়েলী বাহিনী ১৫ হাজার সৈন্য যুদ্ধাস্ত্রসহ জর্ডান নদী পাড় হয়। এই সময় প্রায় ৪শফেদায়িন বা সর্গীকৃত আত্মত্যাগী যোদ্ধা হাল্কা মেশিনগান, এন্টিট্যাংক গান গ্রেনেডসহ হাল্কা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে এই বাহিনীকে রুখে দাঁড়ানোর সংকল্প ব্যক্ত করে। ফিলিস্তিনিদের কাছে এই লড়াই হয়ে ওঠে আত্মমর্যাদা রক্ষার লড়াই। ইসরায়েলী বাহিনীর সাথে এই অসম লড়াইয়ে জড়িয়ে পরার কারণ হলো, ফিলিস্তিনিরা ভাবতে থাকে ইসরায়েলীদের যদি ফিলিস্তিনিরা  এই লড়াইয়ে প্রতিরোধ করতে না পারে তবে বিশ্বের জনগণের কাছে তারা হেয় হয়ে যাবে, তাদের জাতীয় মর্যাদা ধুলোয় মিশে যাবে। তারা তাই সংকল্প করে, ইসরায়েলীদের তারা অক্ষত ফিরতে দেবে না। কারামের এই যুদ্ধে ইসরায়েলী বাহিনীর বেশ ক্ষতি সাধিত হয়। ফিলিস্তিদের প্রায় ১৫০ জন আত্মত্যাগী যোদ্ধা বা ফেদায়িন শাহাদ বরণ করে
এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সাহসিকতা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা সারা আরব বিশ্ব এবং বিশেষ করে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিদের মনে উদ্যম, সাহস লড়াকু মানসিকতা উজ্জীবিত করে তোলে। এই লড়াইয়ে জীবনের বিনিময়ে ইসরায়েলীদের নাস্তানাবুদ করতে পেরে বিশ্বের লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শাহাদা বরণের গর্ব নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। ফেদায়িনদের এই আত্মত্যাগ ফিলিস্তিনিদের মনে জাগরণের সৃষ্টি করে। এবং এই লড়াইয়ের ফলে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধকামী সংগঠন পিএলও এবং ফাতাহ পরিচিতি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হিসেবে তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে


পিএলও গঠন
১৯৬৪ সালের ২৮ মে গঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন(পিএলও) জেরুজালেমে ১৯৬৪ সালের ২৮ মে থেকে ০২ জুন পর্যন্ত প্যালেস্টানিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে উক্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান করা হয়। সংগঠনের লক্ষ্য হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলা হয়। পিএলও মূলত, প্যালেস্টাইনে সক্রিয় বিভিন্ন অধিকারকামী সংগঠন-গ্রুপ-গোষ্ঠীর একটি আমব্রেলা বা সম্মিলিত প্রতিনিধিত্বমূলক প্লাটফর্ম।আরবদেশগুলো এই সংস্থাকে ১৯৭৪ সালের দিকে প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
পিএলও গঠিত হবার পরে ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের লড়াই ত্বরান্বিত হতে থাকে। আগে ফিলিস্তিনি জনগণের কোনো ধরণের বৈধ সংগঠন না থাকায় লড়াইকে এগিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছিল। পিএলওতে অন্যান্য সংগঠনসমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ সংগঠনই এই সংগঠনকে প্রধানত নেতৃ্ত্ব প্রদান করেছে। এই আল ফাতাহ সংগঠন ছাড়াও আরও দুটি সংগঠন ফিলিস্তিনি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে এখনো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে এই দুই সংগঠনের কাজের কিছু ধরণ নিয়ে আলোচনা করলে ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনকে আরো ভালো করে বোঝা সম্ভব হবে।

পিএফএলপি বা পপুলার ফ্রন্ট অব দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন
বামপন্থী বা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারার এই সংগঠন ১৯৬৭ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন জর্জ হাবাশ। তিনি একজন প্যালেস্টাইনী খ্রিস্টান। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনি অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সৎ এবং ন্যায়পরায়ন একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। আল হাকিম নামে সহযোগীদের কাছে পরিচিতি ছিলেন। আল হাকিম অর্থ জ্ঞানী বা ডাক্তার। জর্জ হাবাশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন প্যালেস্টাইনী জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করার জন্য ‘সন্ত্রাসবাদী’ ধারার কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করা, ইহুদীদের জিম্মি হিসেবে ব্যবহার ইত্যাদি কাজ করে এই সংগঠন আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তবে জর্জ হাবাশ এই ’সন্ত্রাসবাদী’ কাজকে সাময়িকভাবে সমসাময়িক পরিস্থিতির ভিত্তিতে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষে নিজের মত ব্যক্ত করেছেন। স্থায়ীভাবে শুধুমাত্র ’সন্ত্রাসবাদী’ কাজ করার নীতিকে তিনি সমর্থন করেননি। তিনি একইসাথে একজন গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে বিবেচিত ছিলেন। তিনি বা তার সংগঠন এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেছেন যে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র সামরিকভাবে আক্রমণ না করে তার বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিকভাবে লড়াই্ও চালিয়ে যেতে হবে। এভাবে ইসরায়েলকে স্থায়ীভাবে ব্যাপক চাপের মধ্যে রাখতে হবে।
এই সংগঠন প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রে আদর্শিকভাবে বাস্তবতা বিবর্জিত স্বপ্ন না দেখতে ও বর্তমান এবং অতীতের বাস্তব মূল্যায়ণের মাধ্যমে ভবিষ্যত নির্মাণের আহ্বান জানায়।
এই সংগঠনেরই একজন সদস্য, যিনি একজন নারী, নাম লায়লা খালেদ। ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনে নারী সংগ্রামী বলতেই বোঝানো হয় লায়লা খালেদকে। তিনি বিমান ছিনতাইয়ে দুঃসাহসিক নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সারাবিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ১৫ বছর বয়স থেকে সংগঠনের কাজে যোগদান করেন। বেশ কিছুদিন তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এরপর তিনি পিএফএলপির বিশেষ মিশনে অংশ নিয়ে বিমান ছিনতাইয়ে নেতৃত্ব প্রদান করেন। বিমান ছিনতাই করার পরে তিনি গ্রেপ্তারও বরণ করেন। পিএফএলপির এই ’সন্ত্রাসবাদী’ কাজের একটি ধরণ ছিলো, তারা বিমান ছিনতাই করার পরে বিমানের যাত্রীদের সবাইকে নিরাপদে অবতরণ করার ‍সুযোগ করে দিতেন। তারপরে বিমানটি তারা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতেন। পিএফএলপির এই ধরণের একান্তই প্রচারণামূলক ‘ছিনতাই’ কাজের জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের আন্দোলনের কথা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের নিপীড়িত জনগণ ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য লড়াইকে সমর্থন প্রদান করতে থাকে।

হামাস বা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন
এই সংগঠন আদর্শিকভাবে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। মূলত, সামাজিক সেবা ও অর্থনৈতিক নানা ধরণের কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে এই সংগঠন ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৭ সালে এই সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শেখ আহমদ ইয়াসিন হলেন এই সংগঠনের ভাবাদর্শিক নেতা। ২০০৪ সালে তাকে ইসরায়েল রাষ্ট্র হত্যা করে।
এই সংগঠন রকেট দিয়ে ইসরায়েলের সেনা ও সাধারণ জনগণের উপর নির্বিচার আক্রমণ, আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ইসরায়েলকে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করে।

সংগঠনটি বর্তমানে ফিলিস্তিন অধ্যুষিত গাজা অঞ্চল শাসন করছে। হামাস ইরান প্রভাবিত সংগঠন হিসেবে বিবেচিত।

ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াই
১৯৬৯ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম কাউন্সিলে পিএলও তাদের উদ্দেশ্য লক্ষ্য হিসেবেস্বাধীন ফিলিস্তিনে/প্যালেস্টাইনে মুসলিম,খ্রিস্টান, ইহুদীসহ সকলের জন্য স্বাধীন মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠারঅঙ্গীকার ব্যক্ত করে। ইয়াসির আরাফাত ছিলেন এই সংগঠনের নেতা। ১৯৭৪ সালে মিশরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত পিএলও সম্মেলনে দশদফা কর্মসূচি ঘোষনা করা হয়। এই কর্মসূচিতে ইসরাইলী-প্যালেস্টাইনিয়ান গণতান্ত্রিক দ্বিজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ঘোষনা দেয় হয়।
১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩২/৪০ নম্বরের একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বছরের ২৯ নভেম্বরকে প্যালেস্টাইনী জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস পালনের ঘোষনা করা হয়। এই দিনটিতে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশ করে নানা ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করে। এছাড়া এই দিনটিতে ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে বিশ্নজনমত গঠনের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জনগণ-ব্যক্তি-সংস্থা-এনজিও এবং রাজনৈতিক দলগুলোও নানা ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে
১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আমেরিকার মধ্যস্থতায় প্যালেস্টাইনের জনগণ ইসরাইলের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের উপস্থিতিতে উক্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের আগে গোপনে ১২ দিন ধরে আলোচনা চলে। 
এই চুক্তিতে দুইটি অংশ ছিল। প্রথমটি হল, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ফ্রেমওয়ার্ক বা কার্যকাঠামো নির্ধারণ। এই কার্যকাঠামো অনুযায়ী পশ্চীম তীর গাজা ভূখন্ডকে নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত শাসন ব্যবস্থা সম্বলিত কর্তৃপক্ষ গঠনের পক্ষে ঐক্যমত সৃষ্টি হয়।  দ্বিতীয়টি হল, মিশর ইসরাইলের মধ্যে শান্তি সমঝোতা স্বাক্ষর করার কার্যকাঠামো নির্ধারণ করা। সে অনুযায়ী ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে ইসরাইল মিশরের মধ্যে শান্তি সমঝোতার সৃষ্টি হয়। 
এই চুক্তিতে প্যালেস্টাইনী জনগণের কোন প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তবে এই চুক্তির মাধ্যমে বহুপাক্ষিক এই সংঘাতের মূল দুই গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ মিশর ইসরাইল সমঝোতায় উপনীত হওয়ায় সংঘাতের মাত্রা কমার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর আলজেরিয়ার আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পিএলও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ঘোষনা প্রদান করেন। ১৯৯৩ সালে ইসরাইলের সাথে পিএলও চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির নাম অসলো চুক্তি। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীর গাজা ভুখন্ডকে নিয়ে ফিলিস্তিন/প্যালেস্টাইন গঠনের কথা বলা হয়। 

প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক ধাপ 
২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে প্রথমবারের মত সদস্যবহির্ভুত পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। এই মর্যাদা প্রাপ্তির পরে ফিলিস্তিনের প্রশাসনিক চিঠিপত্র-দলিল দস্তাবেজ-সিলমোহর-স্বাক্ষরেপ্যালেস্টাইনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটিলেখার বদলেস্টেট অব প্যালেস্টাইনলেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফিলিস্তিন সরকার। ২০১৩ সালের জানুয়ারি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বিভিন্ন দেশে তাদের যে দূতাবাস রয়েছে তাতে রাষ্ট্রের নামপ্যালেস্টাইনিয়ান অথরিটি পরিবর্তেস্টেটে অব প্যালেস্টাইনলেখার নির্দেশনা প্রদান করেন। 
২০১৫ সালে জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউ ইয়র্কে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের পতাকাও উত্তোলন করা হয়। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সাধারণভাবে স্বাধীন রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলনের রেওয়াজ আছে। সেদিক থেকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এই পদক্ষেপ এক বিরাট অগ্রগতি। 
ইসরাইল নামক ইহুদী রাষ্ট্র গঠিত হবার আগে ১৯১৮ সালের জনগণনার এক হিসাব মতে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে লাখ আরব জাতিগোষ্ঠীর জনগণ ৫৬ হাজারের মতো ইহুদী জাতিগোষ্ঠীর জনগণ বসবাস করত। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ পরিচালিত জনসংখ্যা গণনায় দেখা যায় প্যালেস্টাইনের লাখ ৫০ হাজার জনগণের মধ্যে ৭৮ শতাংশ ছিল মুসলিম, ১০ শতাংশ খ্রিস্টান এবং বাকি ১১ শতাংশ ছিল ইহুদী জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। ১৯৪৭ সালে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৮ লাখ। তারমধ্যে ৬০ শতাংশ ছিল মুসলিম, ৩১ শতাংশ ইহুদী এবং শতাংশ ছিল খ্রিস্টান। বর্তমানে উক্ত অঞ্চলে ইহুদীদের অনুপাত হলো ৫৩ শতাংশ। আর মুসলিমরা হল মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ। বাকি দুই শতাংশ হল খ্রিস্টান। 
এভাবে গত প্রায় একশবছর ধরে জনসংখ্যাগত দিক থেকে ইহুদীরা প্যালেস্টাইনীয়দের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। একইসাথে তারা ভূখন্ড দখলে নিয়ে তাদের দখলদারিত্ব নিরংকুশ করতে সক্ষম হয়েছে। 
তবে ইহুদীদের এই আধিপত্যবাদী ধারার বিপরীতে প্যালেস্টাইনীয় জনগণ এখনো লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। প্যালেস্টাইনীয়দের বা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের যে সংগ্রাম তার সাথে জড়িয়ে আছে জায়নবাদী বা ইহুদীবাদী কট্টরপন্থার মত জাত্যাভিমানী দৃষিভঙ্গির বিপরীতে নিপীড়িত জনগণের লড়াইয়ের ন্যায্য পরিণতির নতুন ভবিষ্যত রচনার জন্য রাজপথ সৃষ্টির আকাঙ্খা। এর সাথে জড়িয়ে আছে আধিপত্যবাদী শাহীসাম্রাজ্য ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন ব্যবস্থা তথা শোষণবঞ্চনাহীন সমাজ গঠনের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টার সার্থক রূপায়নের আকাঙ্খার। 

সূত্র:
7.       http://www.meforum.org/


9. https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_the_Jews_and_Judaism_in_the_Land_of_Israel


10. প্যালেস্টাইন এক সংগ্রামের ইতিহাস- গাজীউল হাসান খান; দিব্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১১
11. প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট।


সর্বাধিক পঠিত

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষাঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসংগ-১৯৪৭ সাল

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষা তারিখঃ ১৬ আগস্ট, ২০১৭ ইতিহাস একটি জাতি বা জাতিসত্তা তথা জাতিসমষ্টিকে নানাভাবে প্রভাবিত কর...