মিঠুন চাকমা
ভূমিকা
১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের
সাধারণ পরিষদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, প্রতিবছরের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনি
জনগণের অধিকারের পক্ষে সংহতি প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস পালন করা হবে।
তারপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশের
জন্য পালন করা হয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও সাধারণভাবে এই দিবসটি পালন করা হয়।
আমাদের মনে হয়েছে, এই
দিবসটি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার সাথে পালন না করে এই দিবসকে উপলক্ষ করে আমাদের এই
লড়াইকে বোঝা জানা এবং নিপীড়িত জনগণের এই লড়াই থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার প্রয়োজন
রয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের আন্দোলন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার আদায়কামী
জনগণের অনেক কিছুই শেখার রয়েছে।
এই উদ্দেশ্যকে সামনে
রেখে ফিলিস্তিনি জনগণ বা প্যালেস্টাইন অঞ্চলের জনগণের আন্দোলনের সাধারণ সংক্ষিপ্ত
বর্ণনা আমরা নিচের আলোচনায় ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছি।
এই লেখাটিতে ফিলিস্তিনি
জনগণের লড়াই সংগ্রামের সাধারণ বর্ণনা মাত্র দেয়া হয়েছে। সুতরাং, এই লেখা পড়ে আমরা
ফিলিস্তিনি জনগণের লড়াইকে সার্বিকভাবে বুঝতে পারবো না। তবে সাধারণ সংক্ষিপ্ত
বর্ণনা করে আমরা এই লড়াইয়ের মুখ্যদিকগুলো গোচরীভূত করার চেষ্টা করেছি।
এই সংক্ষিপ্ত লেখাটি
পাঠকগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ
প্যালেস্টাইন ভূখন্ডের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভৌগোলিক ও কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্যালেস্টাইন অঞ্চল এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের সীমানা বিন্দুতে অবস্থিত। সংস্কৃতি-ধর্ম-অর্থনীতি ও রাজনীতিসহ নানাদিক থেকে এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে ক্রশরোড বা সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করেছে। এই অঞ্চলের কথা লেখা রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মে, ইসলাম ধর্মে ও ইহুদী ধর্মে। অনেক নবী-রাসূলগণ এই অঞ্চলে জন্মেছেন। এই সকল কারণে এই অঞ্চল বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে দেখে থাকে ইসলাম-খ্রীস্টিয় ও ইহুদী ধর্মের শতকোটি জনগণ। একসময় এই অঞ্চলের নাম ছিল ’কানান’। খ্রীস্টপূর্ব ১১৫০-১২০০ শতকের সময় এই অঞ্চলটি মিশরের শাসনাধীন ছিল। মূলত, ফিলিস্তিনী, ইহুদী ও আরব জাতি বা তৎকালীন সময়ে এই সকল জাতিগোষ্ঠী বা গোষ্ঠীভ’ক্ত জনগণ তখন এই এলাকায় বসবাস করত। খ্রীস্টপূর্ব ৭০০ শতকের সময় এই অঞ্চলটি এসিরিয়দের শাসনে চলে যায় এবং ফিলিস্তিনীয়রা তাদের রাজ্য হারিয়ে ফেলে। এরপর পার্সিয়ানরা অঞ্চলটি দখল করে। পরবর্তীতে রোমানরা অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তখন এই অঞ্চলটির নাম ছিল জুদাইয়া, এবং তখন ইহুদীরা সেখানে বসবাস করত। খ্রীস্টিয় ৬৬ থেকে ৭০ সালে ইহুদীরা রোমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করে। এই লড়াইয়ে প্রায় ১১ লাখ লোক মারা যায়। এছাড়া ১১৫-৭ খ্রীস্টাব্দে আরেকবার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ১৩২ তেকে ১৩৬ খ্রীস্টাব্দে সংঘটিত হয় বার-কোখবা যুদ্ধ। এতে ইহুদীরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় এবং সেখান থেকে তারা অনেকেই বিতাড়িত হয়ে চলে যায়। খ্রীস্টানদের প্রাধান্য রোমানদের বিজয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রীস্টিয় ৩০০ থেকে ৬৫০ অব্দ পর্যন্ত খ্রীস্টানরা উক্ত এলাকা শাসন করে। এরপর অঞ্চলটিতে মুসলিশ শাসকরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। মুসলিম শাসকরা শাসনক্ষমতায় আসার পরে ইহুদীরা আবার ফিরে আসে। খ্রীস্টিয় ১০০০ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিমরা অঞ্চলটি শাসন করতে সক্ষম হয়। এরপর খ্রীস্টান ও মুসলিমদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড শুরু হয়। ১২৫০ সাল পর্যন্ত তাদের মধ্যে যুদ্ধ চলে এবং কোনসময় খ্রীস্টানরা বিজয়ী হতে সক্ষম হলেও কোন কোন সময় মুসলিমরাও বিজয়ী হতে সক্ষম হয়। এরপরে তুর্কীরা ১৫ শতকের কিছুসময় তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এই শতশত বছর ধরে খ্রীস্টান-ইহুদী ও মুসলিমরা তাদের সবার জন্য পবিত্র শহর জেরুজালেম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা নিজেদের মতো করে গিয়েছিল।
১৭ শতক থেকে বিশ শতক পর্যন্ত নানা উত্থান পতন ঘটতে থাকে এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শাসকদের মধ্যে। ১৭৯৮ থেকে ১৮০০ সালের দিকে নেপোলিয়ন এই অঞ্চলসহ জর্ডান এলাকা দখল করে। পরে তা আবার তুর্কীদের হাতে চলে যায়। তুর্কীরা দুর্বল হতে থাকে এবং ১৯১৬ সালের ১৬ মে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সাইকস-পিকট চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুযায়ী ধরে নেয়া হয় যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে তুর্কী সাম্রাজ্য দুর্বল হবে। এবং এই দুর্বলতার কারণে তুর্কী তার সাম্ররাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে তুর্কীদের হৃত সাম্রাজ্যের কোন অঞ্চল কে দখলে নেবে তা নিয়ে যে চুক্তি করেছিল তা-ই ছিল সাইকস-পিকট চুক্তি। সে অনুযায়ী প্যালেস্টাইন অঞ্চল ব্রিটেনের হাতে চলে যায়। ১৯১৭ সালের শেষদিকে ব্রিটেন তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য থেকে প্যালেস্টাইনের গাজা-জেরুজালেমসহ বিভিন্ন এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়।
বেলফোর ডিক্লারেশন
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটেনের তখনকার ফরেন সেক্রেটারী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর জায়নবাদী/ইহুদীবাদী আন্দোলনের নেতা ব্যারন রথসচাইল্ডকে একটি চিঠি লিখলেন। এতে তিনি লেখেন, ’ সরকারের পক্ষ থেকে আমার একথাটি আপনাকে জানাতে বড়ই ভাল লাগছে যে, ইহুদীদের জায়নবাদী আকাঙ্খার প্রতি সহমর্মিতা স্বরূপ নিম্নোক্ত ঘোষনা ব্যক্ত করছে, যা একইসাথে মন্ত্রীপরিষদ বা কেবিনেটে উপস্থাপন ও অনুমোদন করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত চিঠিতে এরপর তিনি ইহুদী জনগণের জন্য প্যালেস্টাইনীয় অঞ্চলে একটি জাতীয় ভূখন্ড প্রদানের পক্ষে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুললেন।
১৯১৯ সালে তিনি এক মেমোরেন্ডামে লিখলেন, ’ইহুদীবাদ সঠিক অথবা বেঠিক যাই হোক না কেন তার গুরুত্ব ৭ লাখ আরব জনগণের চেয়েও অধিক বেশি’। তখন প্যালেস্টাইনের জনসংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৫০ হাজার। তার মধ্যে ৭ লাখই ছিল প্যালেস্টাইনীয়।
১৯৩৬-৩৯ সালে
আরব-প্যালেস্টাইনীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম
বেলফোর ডিক্লারেশনের পরে ইহুদীরা তাদের দেশ তৈরীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতে থাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ইহুদীরা প্যালেস্টাইন ভূখন্ডে আসতে থাকে। প্যালেস্টাইনীয় আরবরা ব্রিটেনের দখলদারিত্ব, ইহুদীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৩৬ সালের অক্টোবরের দিকে শহর এলাকায় ধর্মঘট ও প্রতিবাদী সমাবেশের ডাক দেয়। তৎকালীন প্যালেস্টানীয় নেতা খলিল আল-সাকাকিনি অধিকার আদায়ের জন্য ’জীবন মরণের সংগ্রামে’ ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান। কিন্তু ব্রিটেন এই প্রতিবাদ প্রতিরোধ কঠোর হাতে দমন করে। পরে ১৯৩৭ সালের আরব প্যালেস্টাইনীয়রা সহিংসভাবে বিক্ষোভ সংঘটিত করতে থাকে। ব্রিটেনও সহিংসভাবে প্রতিবাদ দমনের উদ্যোগ নেয়। এই লড়াইয়ে ২ হাজার আরব যোদ্ধা প্রাণ হারায়। ১০৮ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
ফেদায়িন বা উৎসর্গীকৃত আত্মত্যাগী বাহিনী
ষাট বছরের অধিক বয়সী ইসলামী চিন্তাবিদ শেখ ইজ্জেদদীন কাশাম। ১৯৩৫ সালের ১২ নভেম্বর ইহুদীদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ফেদায়িন বা উৎসর্গীকৃত আত্মত্যাগী বাহিনী গঠনের আহ্বান জানান। তিনি হাজার খানেক তরুণ সদস্য সংগ্রহ করেন। তাদের দিয়ে তিনি আত্মঘাতী আক্রমণের সূচনা করেন। এবং এক পর্যায়ে তিনি এক আক্রমণের শাহাদৎ বরণ করেন। তাঁর এই উদ্যোগের ফলে আরব প্যালেস্টাইনীদের মধ্যে জাগরণের ঢেউ ওঠে। তার আদর্শ আরবদের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মানসিকতার সৃষ্টি হয়।
প্যালেস্টাইনীয়দের এই প্রাথমিক পর্যায়ের সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যায়। কিন্তু তারা তারপরেও থেমে থাকেনি। একইসাথে ইহুদীদের রাষ্ট্র ইসরাইল গঠনের তৎপরতাও চলতে থাকে।
ইহুদী জাতির উত্থান বা রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের আবির্ভাব
ইহুদী নামের জাতিগোষ্ঠীর জনগণের ধর্ম হচ্ছে েইহুদী ধর্ম। এই ধর্মের জন্মস্থান হিসেবে বর্তমান ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়। খ্রীস্টের জন্মের একহাজার বা তারও অধিক বছর আগে বর্তমান ফিলিস্তিন বা ইসরায়েলের কিছু এলাকায় ইহুদী জাতি বসবাস করতো বলে ইহুদী ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে। ইতিহাস মতে জানা যায় এই এলাকায় একসময় ‘জুডাহ’ রাজ্যের অস্তিত্ব ছিলো। এই জুডাহ রাজ্যের জনগণকেই ইহুদী জাতির পূর্বপুরুষ বলে অভিহিত করা হয়। তবে খ্রীস্টপূর্ব ৭শ’ শতকের দিকে এই রাজ্য নয়া এসিরিয় সাম্রাজ্য কর্তৃক পরাভূত হয়। ইহুদী জাতির লোকজনকে তাদের নিজ আবাসভূমি থেকে পালিয়ে যেতে হয়। হাজার বছরের ব্যবধানে তারা সারাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সাংস্কৃতিকভাবে তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। এবং তারা নানা বিপদ আপদ মোকাবেলা করে নানা জায়গায় ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা পেশায় উন্নতি লাভ করতে থাকে। একসময় তারা অনুভব করতে থাকে যে, তাদের নিজস্ব আবাসভূমি থাকা প্রয়োজন। পৃথিবীর নানা জায়গায় নানাভাবে নিগৃহীত, নির্যাতিত হতে হতে তাদের মধ্যে এই বোধ জন্মায়।
নিজস্ব আবাসভূমি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রথম বাস্তবকাজে হাত দেন থিওডোর হারাজেল নামে এক ইহুদী। তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক। তিনি ফ্রান্সের এক প্রভাবশালী পত্রিকায় কাজ করতেন। তিনি ১৮৯৭ সালের দিকে সুইৎজারলান্ডের বাজেল নামক স্থানে ইহুদীদের নিয়ে এক সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে গঠন করা হয় দ্য ওয়ার্ল্ড জিউইশ অর্গানাইজেশান। তিনি এই সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে স্বীকৃত একটি ইহুদী জাতির দেশ গঠনের মাধ্যমেই ইহুদী জাতির দুরবস্থা দূর হতে পারে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি জনমত গঠন ও বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাহায্য লাভের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন। এছাড়া এই কাজকে এগিয়ে নিতে যে অর্থের প্রয়োজন তার সংস্থান করতে তিনি বিশ্বের বিভিন্নস্থানে অবস্থানরত ধনী ইহুদীদের কাছ থেকে ফান্ড সংগ্রহের জন্য প্রস্তাব করেন। তবে দেখা যায়, প্রথমদিকে ধনী বা প্রভাবশালী ইহুদী ব্যক্তিগণ তেমন সাহায্য করেনি। কিন্তু, সাধারণ ইহুদী জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে
সহায়তা দিতে থাকে।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে পরে ইহুদী নেতৃবৃন্দ গোপনে নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। নিজেদের একটি দেশ গঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তারা ফিলিস্তিনের জেরুজালেম, তেল আবিব ইত্যাদি এলাকায় ব্যাপকভাবে ইহুদী জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের কাজ হাতে নেন। উক্ত এলাকা ও তার আশেপাশের এলাকাগুলো তখন অনুর্বর ছিলো। এই এলাকাগুলো বেশিরভাগই শহরে বা দূর অঞ্চলে বসবাসকারী জমিদার-ধনীদের মালিকানায় ছিলো। ইহুদীরা ছলে বলে কৌশলে এই এলাকার হাজার হাজার একর দাম দিয়ে জমিদার বা ধনীদের কাছ থেকে কিনে নিতো। এছাড়া সাধারণ স্থানীয় আরবদের কাছ থেকেও তারা জায়গাগুলা কিনে নিতো। আর অনেকের কাছ থেকে তারা জোর করে জায়গাগুলো দখলে নিতো। এভাবে তারা বিরাট এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়।
তারপর তারা অগ্রসর হয় নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার কাজে। তারা সংগৃহীত ফান্ডের মাধ্যমে এবং প্রভাবশালী ইহুদীদের মাধ্যমে তাদের নিজেদের জন্য একটি আবাসভূমি গঠনের সপক্ষে বিশ্বে প্রচারণা চালাতে থাকে। একইসাথে তারা নিজেদের জনবল ও অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান করতে থাকে।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে তারা স্বাধীন ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেয়।
আজ পর্যন্ত এই রাষ্ট্র নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে টিকে আছে এবং ভবিষ্যতে আরও অনেক বছর এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই প্রতীয়মান।
প্যালেস্টাইনকে দুইভাগ করার জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৮১(২) নং সিদ্ধান্ত বা রেজ্যুলেশনের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন অঞ্চলকে দুইভাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। উক্ত সিদ্ধান্তে প্যালেস্টাইনের মোট ভূখন্ডের ৫৬.৪৭ ভাগ ইহুদী রাষ্ট্রের জন্য এবং বাকী ৪৩.৫৩ ভাগ আরব প্যালেস্টাইনীয়দের দেয়ার কথা বলা হয়। জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্ত আরবরা মানতে পারেনি। কিন্তু ইহুদীরা তা মেনে নেয় এবং এর ভিত্তিতে তাদের নিজেদের দেশ গঠন করতে তারা অগ্রসর হতে থাকে।
জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মতে প্যালেস্টাইন ও ইসরাইল নামে দুইটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার কথা থাকলেও ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরাইল নামক একটি সেটলার স্টেট বা দেশ গঠিত হয়। এই রাষ্ট্রগঠনকে কেন্দ্র করে ইসরাইল-আরব যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইসরাইল তার পেশীশক্তি তথা সমরশক্তি প্রয়োগ করে ফিলিস্তিন ভূখন্ডের অনেক এলাকা নিজের করায়ত্তে নিয়ে নেয়। জেরুজালেম শহর বিশেষ আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত হবার কথা থাকলেও ইসরাইল এই শহরটিও দখল করে নেয়। এই শহরটি মূলত ইসলাম-খ্রীস্টান ও ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে এলাকা নিয়ে ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠন হবার কথা ছিল তার ২৬ শতাংশ এলাকাও ইসরাইল দখল করে নেয়। এসময় একদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ইহুদীরা বিপুল সংখ্যায় ইসরাইলে আসতে থাকে এবং অন্যদিকে সেই বছরেই প্রায় ৭ লাখ প্যালেস্টাইনী জনগণ নিজেদের জায়গাজমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।
১৯৬৭ সালের জুন মাসে ৫ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত ইসরাইল ও আরবদের মধ্যে ৬দিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে ইসরাইল মিশর থেকে দখল করে গাজা স্ট্রীপ ও সিনাই উপত্যকা, জর্ডানকে পরাজিত করে দখল করে নেয় পশ্চীম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নেয় গোলান মালভ’মি। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মিশর ও সিরিয়ার সাথে ইসরাইলের আবার যুদ্ধ হয়। ইসরাইল বিবদমান দুই পক্ষের সাথে দখলীকৃত ভুখন্ড নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
কারামে যুদ্ধে আত্মমর্যাদার লড়াই
১৯৬৮ সালের মার্চমাসে ইসরায়েল জর্ডানে ফিলিস্তিনিদের শরনার্থী অধ্যূষিত এলাকায় আক্রমণ চালায়। মার্চের ২১ তারিখ ইসরায়েলী বাহিনী ১৫ হাজার সৈন্য ও যুদ্ধাস্ত্রসহ জর্ডান নদী পাড় হয়। এই সময় প্রায় ৪শ’ ফেদায়িন বা উৎসর্গীকৃত আত্মত্যাগী যোদ্ধা হাল্কা মেশিনগান, এন্টিট্যাংক গান ও গ্রেনেডসহ হাল্কা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে এই বাহিনীকে রুখে দাঁড়ানোর সংকল্প ব্যক্ত করে। ফিলিস্তিনিদের কাছে এই লড়াই হয়ে ওঠে আত্মমর্যাদা রক্ষার লড়াই। ইসরায়েলী বাহিনীর সাথে এই অসম লড়াইয়ে জড়িয়ে পরার কারণ হলো, ফিলিস্তিনিরা ভাবতে থাকে ইসরায়েলীদের যদি ফিলিস্তিনিরা এই লড়াইয়ে প্রতিরোধ করতে না পারে তবে বিশ্বের জনগণের কাছে তারা হেয় হয়ে যাবে, তাদের জাতীয় মর্যাদা ধুলোয় মিশে যাবে। তারা তাই সংকল্প করে, ইসরায়েলীদের তারা অক্ষত ফিরতে দেবে না। কারামের এই যুদ্ধে ইসরায়েলী বাহিনীর বেশ ক্ষতি সাধিত হয়। ফিলিস্তিদের প্রায় ১৫০ জন আত্মত্যাগী যোদ্ধা বা ফেদায়িন শাহাদৎ বরণ করে।
এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা সারা আরব বিশ্ব এবং বিশেষ করে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিদের মনে উদ্যম, সাহস ও লড়াকু মানসিকতা উজ্জীবিত করে তোলে। এই লড়াইয়ে জীবনের বিনিময়ে ইসরায়েলীদের নাস্তানাবুদ করতে পেরে বিশ্বের লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শাহাদাৎ বরণের গর্ব নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। ফেদায়িনদের এই আত্মত্যাগ ফিলিস্তিনিদের মনে জাগরণের সৃষ্টি করে। এবং এই লড়াইয়ের ফলে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধকামী সংগঠন পিএলও এবং ফাতাহ’র পরিচিতি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী
সংগঠন হিসেবে তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।
পিএলও গঠন
১৯৬৪ সালের ২৮ মে গঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন(পিএলও)। জেরুজালেমে ১৯৬৪ সালের ২৮ মে থেকে ০২ জুন পর্যন্ত
প্যালেস্টানিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে উক্ত
সংগঠন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান করা হয়। সংগঠনের লক্ষ্য হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রামের
মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলা হয়। পিএলও মূলত, প্যালেস্টাইনে
সক্রিয় বিভিন্ন অধিকারকামী সংগঠন-গ্রুপ-গোষ্ঠীর একটি আমব্রেলা বা সম্মিলিত
প্রতিনিধিত্বমূলক প্লাটফর্ম।আরবদেশগুলো এই সংস্থাকে ১৯৭৪ সালের দিকে প্যালেস্টাইন
বা ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের
তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
পিএলও গঠিত হবার পরে
ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের লড়াই ত্বরান্বিত হতে থাকে। আগে ফিলিস্তিনি জনগণের
কোনো ধরণের বৈধ সংগঠন না থাকায় লড়াইকে এগিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছিল। পিএলওতে
অন্যান্য সংগঠনসমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ সংগঠনই এই সংগঠনকে
প্রধানত নেতৃ্ত্ব প্রদান করেছে। এই আল ফাতাহ সংগঠন ছাড়াও আরও দুটি সংগঠন
ফিলিস্তিনি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে এখনো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে
যাচ্ছে। এখানে এই দুই সংগঠনের কাজের কিছু ধরণ নিয়ে আলোচনা করলে ফিলিস্তিনিদের
আন্দোলনকে আরো ভালো করে বোঝা সম্ভব হবে।
পিএফএলপি বা পপুলার ফ্রন্ট অব দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন
বামপন্থী বা
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারার এই সংগঠন ১৯৬৭ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই
সংগঠনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন জর্জ হাবাশ। তিনি একজন প্যালেস্টাইনী খ্রিস্টান। তিনি
ছিলেন ফিলিস্তিনি অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সৎ এবং
ন্যায়পরায়ন একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। আল হাকিম নামে
সহযোগীদের কাছে পরিচিতি ছিলেন। আল হাকিম অর্থ জ্ঞানী বা ডাক্তার। জর্জ হাবাশ
কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন প্যালেস্টাইনী জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে
আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করার জন্য ‘সন্ত্রাসবাদী’ ধারার কাজে জড়িত হয়ে পড়ে।
যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করা, ইহুদীদের জিম্মি হিসেবে ব্যবহার ইত্যাদি কাজ করে এই
সংগঠন আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তবে জর্জ হাবাশ এই ’সন্ত্রাসবাদী’
কাজকে সাময়িকভাবে সমসাময়িক পরিস্থিতির ভিত্তিতে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষে
নিজের মত ব্যক্ত করেছেন। স্থায়ীভাবে শুধুমাত্র ’সন্ত্রাসবাদী’ কাজ করার নীতিকে
তিনি সমর্থন করেননি। তিনি একইসাথে একজন গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে
সবার কাছে বিবেচিত ছিলেন। তিনি বা তার সংগঠন এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেছেন যে,
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র সামরিকভাবে আক্রমণ না করে তার বিরুদ্ধে
মনস্তাত্ত্বিকভাবে লড়াই্ও চালিয়ে যেতে হবে। এভাবে ইসরায়েলকে স্থায়ীভাবে ব্যাপক
চাপের মধ্যে রাখতে হবে।
এই সংগঠন প্রতিষ্ঠাকালীন
ঘোষণাপত্রে আদর্শিকভাবে বাস্তবতা বিবর্জিত স্বপ্ন না দেখতে ও বর্তমান এবং অতীতের
বাস্তব মূল্যায়ণের মাধ্যমে ভবিষ্যত নির্মাণের আহ্বান জানায়।
এই সংগঠনেরই একজন সদস্য,
যিনি একজন নারী, নাম লায়লা খালেদ। ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনে নারী সংগ্রামী বলতেই
বোঝানো হয় লায়লা খালেদকে। তিনি বিমান ছিনতাইয়ে দুঃসাহসিক নেতৃত্ব দেয়ার জন্য
সারাবিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ১৫ বছর বয়স থেকে সংগঠনের কাজে যোগদান করেন। বেশ
কিছুদিন তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এরপর তিনি পিএফএলপির বিশেষ মিশনে অংশ
নিয়ে বিমান ছিনতাইয়ে নেতৃত্ব প্রদান করেন। বিমান ছিনতাই করার পরে তিনি গ্রেপ্তারও
বরণ করেন। পিএফএলপির এই ’সন্ত্রাসবাদী’ কাজের একটি ধরণ ছিলো, তারা বিমান ছিনতাই
করার পরে বিমানের যাত্রীদের সবাইকে নিরাপদে অবতরণ করার সুযোগ করে দিতেন। তারপরে
বিমানটি তারা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতেন। পিএফএলপির এই ধরণের একান্তই প্রচারণামূলক
‘ছিনতাই’ কাজের জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের আন্দোলনের কথা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্বের নিপীড়িত জনগণ ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য লড়াইকে সমর্থন প্রদান করতে থাকে।
হামাস বা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন
এই সংগঠন আদর্শিকভাবে
মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। মূলত, সামাজিক সেবা ও
অর্থনৈতিক নানা ধরণের কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে এই সংগঠন ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে
জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৭ সালে এই সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শেখ
আহমদ ইয়াসিন হলেন এই সংগঠনের ভাবাদর্শিক নেতা। ২০০৪ সালে তাকে ইসরায়েল রাষ্ট্র
হত্যা করে।
এই সংগঠন রকেট দিয়ে
ইসরায়েলের সেনা ও সাধারণ জনগণের উপর নির্বিচার আক্রমণ, আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে
ইসরায়েলকে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করে।
সংগঠনটি বর্তমানে
ফিলিস্তিন অধ্যুষিত গাজা অঞ্চল শাসন করছে। হামাস ইরান প্রভাবিত সংগঠন হিসেবে
বিবেচিত।
ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াই
১৯৬৯ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম কাউন্সিলে পিএলও তাদের উদ্দেশ্য লক্ষ্য হিসেবে ’স্বাধীন ফিলিস্তিনে/প্যালেস্টাইনে মুসলিম,খ্রিস্টান, ইহুদীসহ সকলের জন্য স্বাধীন ও মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার’ অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। ইয়াসির আরাফাত ছিলেন এই সংগঠনের নেতা। ১৯৭৪ সালে মিশরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত পিএলও’র সম্মেলনে দশদফা কর্মসূচি ঘোষনা করা হয়। এই কর্মসূচিতে ইসরাইলী-প্যালেস্টাইনিয়ান গণতান্ত্রিক ও দ্বিজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ঘোষনা দেয় হয়।
১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩২/৪০ খ নম্বরের একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বছরের ২৯ নভেম্বরকে প্যালেস্টাইনী জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস পালনের ঘোষনা করা হয়। এই দিনটিতে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশ করে নানা ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করে। এছাড়া এই দিনটিতে ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে বিশ্নজনমত গঠনের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জনগণ-ব্যক্তি-সংস্থা-এনজিও এবং রাজনৈতিক দলগুলোও নানা ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আমেরিকার মধ্যস্থতায় প্যালেস্টাইনের জনগণ ও ইসরাইলের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের উপস্থিতিতে উক্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের আগে গোপনে ১২ দিন ধরে আলোচনা চলে।
এই চুক্তিতে দুইটি অংশ ছিল। প্রথমটি হল, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ফ্রেমওয়ার্ক বা কার্যকাঠামো নির্ধারণ। এই কার্যকাঠামো অনুযায়ী পশ্চীম তীর ও গাজা ভূখন্ডকে নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত শাসন ব্যবস্থা সম্বলিত কর্তৃপক্ষ গঠনের পক্ষে ঐক্যমত সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়টি হল, মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি সমঝোতা স্বাক্ষর করার কার্যকাঠামো নির্ধারণ করা। সে অনুযায়ী ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে ইসরাইল ও মিশরের মধ্যে শান্তি সমঝোতার সৃষ্টি হয়।
এই চুক্তিতে প্যালেস্টাইনী জনগণের কোন প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তবে এই চুক্তির মাধ্যমে বহুপাক্ষিক এই সংঘাতের মূল দুই গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ মিশর ও ইসরাইল সমঝোতায় উপনীত হওয়ায় সংঘাতের মাত্রা কমার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর আলজেরিয়ার আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পিএলও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ঘোষনা প্রদান করেন। ১৯৯৩ সালে ইসরাইলের সাথে পিএলও চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির নাম অসলো চুক্তি। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীর ও গাজা ভুখন্ডকে নিয়ে ফিলিস্তিন/প্যালেস্টাইন গঠনের কথা বলা হয়।
প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক ধাপ
২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে প্রথমবারের মত সদস্যবহির্ভুত পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। এই মর্যাদা প্রাপ্তির পরে ফিলিস্তিনের প্রশাসনিক চিঠিপত্র-দলিল দস্তাবেজ-সিলমোহর-স্বাক্ষরে ’প্যালেস্টাইনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটি’ লেখার বদলে ’স্টেট অব প্যালেস্টাইন’ লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফিলিস্তিন সরকার। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বিভিন্ন দেশে তাদের যে দূতাবাস রয়েছে তাতে রাষ্ট্রের নাম ’প্যালেস্টাইনিয়ান
অথরিটি’র পরিবর্তে ’স্টেটে অব প্যালেস্টাইন’ লেখার নির্দেশনা প্রদান করেন।
২০১৫ সালে জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউ ইয়র্কে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের পতাকাও উত্তোলন করা হয়। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সাধারণভাবে স্বাধীন রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলনের রেওয়াজ আছে। সেদিক থেকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এই পদক্ষেপ এক বিরাট অগ্রগতি।
ইসরাইল নামক ইহুদী রাষ্ট্র গঠিত হবার আগে ১৯১৮ সালের জনগণনার এক হিসাব মতে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে ৭ লাখ আরব জাতিগোষ্ঠীর জনগণ ও ৫৬ হাজারের মতো ইহুদী জাতিগোষ্ঠীর জনগণ বসবাস করত। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ পরিচালিত জনসংখ্যা গণনায় দেখা যায় প্যালেস্টাইনের ৭ লাখ ৫০ হাজার জনগণের মধ্যে ৭৮ শতাংশ ছিল মুসলিম, ১০ শতাংশ খ্রিস্টান এবং বাকি ১১ শতাংশ ছিল ইহুদী জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। ১৯৪৭ সালে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৮ লাখ। তারমধ্যে ৬০ শতাংশ ছিল মুসলিম, ৩১ শতাংশ ইহুদী এবং ৮ শতাংশ ছিল খ্রিস্টান। বর্তমানে উক্ত অঞ্চলে ইহুদীদের অনুপাত হলো ৫৩ শতাংশ। আর মুসলিমরা হল মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ। বাকি দুই শতাংশ হল খ্রিস্টান।
এভাবে গত প্রায় একশ’ বছর ধরে জনসংখ্যাগত দিক থেকে ইহুদীরা প্যালেস্টাইনীয়দের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। একইসাথে তারা ভূখন্ড দখলে নিয়ে তাদের দখলদারিত্ব নিরংকুশ করতে সক্ষম হয়েছে।
তবে ইহুদীদের এই আধিপত্যবাদী ধারার বিপরীতে প্যালেস্টাইনীয় জনগণ এখনো লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। প্যালেস্টাইনীয়দের বা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের যে সংগ্রাম তার সাথে জড়িয়ে আছে জায়নবাদী বা ইহুদীবাদী কট্টরপন্থার মত জাত্যাভিমানী দৃষিভঙ্গির বিপরীতে নিপীড়িত জনগণের লড়াইয়ের ন্যায্য পরিণতির নতুন ভবিষ্যত রচনার জন্য রাজপথ সৃষ্টির আকাঙ্খা। এর সাথে জড়িয়ে আছে আধিপত্যবাদী শাহীসাম্রাজ্য ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন ব্যবস্থা তথা শোষণবঞ্চনাহীন সমাজ গঠনের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টার সার্থক রূপায়নের আকাঙ্খার।
সূত্র:
9. https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_the_Jews_and_Judaism_in_the_Land_of_Israel
10. প্যালেস্টাইন এক সংগ্রামের ইতিহাস- গাজীউল হাসান খান; দিব্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১১।
11. প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন
সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট।