Tuesday, August 15, 2017

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষাঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসংগ-১৯৪৭ সাল

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষা
তারিখঃ ১৬ আগস্ট, ২০১৭
ইতিহাস একটি জাতি বা জাতিসত্তা তথা জাতিসমষ্টিকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ইতিহাস একটি জাতিসত্তা বা জাতিসমষ্টিকে উদ্বুদ্ধ যেমন করতে পারে, অনুপ্রাণিত করতে পারে, তেমনি ইতিহাস একটি জাতি বা জাতিসমষ্টিকে নেতিবাচক শিক্ষাও দিতে পারে। প্রভাবক-প্রতিপত্তিশালী শক্তি ইতিহাসকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে, নিজের মনোমতো করে রচনা করে কোনো জাতি-জাতিসমষ্টিকে পদানত করে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। জাতিসত্তা বা জাতিসত্তাসমূহ এতে নৈতিকভাবে দুর্বল হতেও পারে।
এতে তার লড়াইয়ের শক্তি, প্রতিরোধের শক্তি ক্ষীয়মানও হতে পারে।
তাই একটি সচেতন জাতিসত্তাকে তার ইতিহাসকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে হয়। প্রভাবক প্রতিপত্তিশালী শক্তির 'ইতিহাস ধ্বংসের' সকল ষড়যন্ত্র চক্রান্তমূলক প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিতে হয়।
এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে উইন্সটন চার্চিলের ইতিহাস সংক্রান্ত একটি উদ্ধৃতি কোটেড করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
তিনি বলেছিলেন- আমার আশা এই যে, অতীতের ঘটনাবলী নিয়ে অনুসন্ধান তথা পাঠের মাধ্যমে আগামী ভবিষ্যতের জন্য কোনো নির্দেশনা আমরা পেতে পারি, অতীতে যে ভুল হয়েছে তা সংশোধন করার জন্য নতুন প্রজন্মকে সামর্থ্য অর্জনে সক্ষম করে তুলতে পারে এবং এর মাধ্যমে আগামীর দুঃসহ ইতিহাস, যা এখনো প্রকাশিত হয়ে ওঠেনি, তাকে পরিচালিত করতে পারে জনগনকে সাহসিকতার শিক্ষা দানের প্রয়োজনীয়তার মাধ্যমে।
এত কথা বলার প্রয়োজন হলো এই কারণে যে, এই আগস্ট মাস হলো পার্বত্য জুম্ম জনগণের অতীত ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানোর মাস। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে ভাগ করে দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চলে গিয়েছিল। কিন্তু ভারতবর্ষ'র লক্ষকোটি জনগণের মাঝে চিরস্থায়ী এক যুগপৎ দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য এবং নিয়তির নির্মম পরিণতিতে বরণ করেছিল।
অন্যান্য অঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের লক্ষ-হাজার জনতাকেও এই ইতিহাস প্রভাবিত করেছিল।
আমরা দেখি, এই ইতিহাস সৃষ্টিকালীন সময়ে যারা সেই সময়ে আমাদের জাতিসত্তাসমষ্টিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা নিজেদের সাধ্যমত অনেককিছু করেছেন। তাঁরা পার্বত্য জনগণের জন্য, জনগণের ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন। তবে হয়তো নানা চিন্তাগত সীমাবদ্ধতার কারণে বা নানাধরণের দুর্বলতার কারণে তাঁরা আরো অনেককিছু করতে পারার কথা থাকলেও হয়তো করতে পারেননি! কী করতে পারতেন বা কেন পারেননি তা নিয়ে এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়।
তবে সেই সময়ের ইতিহাস নিয়ে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে, বা হচ্ছে তা নিয়ে এখানে কিছু আলোচনা করা দরকার।
তবে তা সংক্ষেপেই করতে হচ্ছে সংগত কারণে।

এখানে আমি আজকে মাত্র একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়ার চেষ্টা করবো। আমার লেখার শিরোনাম হচ্ছে ‘ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষা’। বলেছিলাম, ইতিহাসেরমধ্যেঅনেকসময় বিভ্রান্তি আমদানী করা হয়,অথবা অনেকেই নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ বা নানা কারণে ইতিহাসরে মধ্যে নানা বিভ্রান্তি উৎপাদন করান!

পার্বত্য চট্টগ্রামকেনিয়ে যারা লিখেছেন তাদের মধ্যে আমি আজকে ড. মানিক লাল দেওয়ান-এর লেখা কিছুটা্ আত্মজীবনী মূলক বই ‘আমি ও আমার পৃথিবী’ থেকে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ইতিহাস সংক্রান্ত তাঁর নিজস্ব অনুধাবন বা বোঝাপোড়া নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করবো।
তিনি তাঁর বইয়ে ‘পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম’ নামে একটি অধ্যায় যুক্ত করেছেন। উক্ত অংশে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন সময়ের অন্যতম একজন নেতা কামিনী মোহন দেওয়ানের বয়ানে সংগ্রামী নেতা স্নেহকুমার চাকমাকে ‘একগুঁয়ে ও ভাবাবেগ প্রাপ্ত উন্মাদ’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। বিষয়টি সাদাচোখে ছোট বা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়বলে মনে হতে পারে। তবে ইতিহাসের নানা বাঁকে আমরা দেখতে পাই, সংগ্রামী ও বিপ্লবী বা জনগণেরসত্যিকার কল্যাণের জন্য কাজ করা অনেক নেতাকে এভাবে চিত্রিত করানোর চেষ্টা করা হয়। এভাবে চিত্রিত করার চেষ্টার অন্যতম কারণ হলো,উক্ত ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা। তবে আমি আমার এই লেখায় এই বিষেয়টি নিয়ে এখানে তেমন কোনো আলোচনাকরবো না। পরে এ বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।
আজকের লেখায় আমি ড. মানিকলাল দেওয়ানের একটি বিষয় পর্যালোচনার দিকে নজর দেবো।

তিনি তার বইয়ে ইতিহাসের আরেকটি বিষয়কে’বিভ্রান্তি’জনকভাবে উপস্থাপন করেছেন। যে কেউ বা সাধারণ কোনো পাঠক এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে ইতিহাস থেকে ‘বিভ্রান্তিকর’ শিক্ষা নিতে পারেন বলে আমাকে সেই বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে হচ্ছে।
মানিকলাল দেওয়ান তার লেখায় যেমন স্নেহ কুমার চাকমাকে উগ্রবাদী এতগুঁয়ে ও ভাবাবেগপ্রাপ্ত উন্মাদ হিসেবে চিত্রিতকরার চেষ্টা করেছেন,তেমনি এই বৈশিষ্ট্যের কারেণে যে পার্বত্য চট্টগ্রামেরজনগণ আজ কষ্ট পাচ্ছে, দুঃখভোগ করছে তা-ই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। ইতিহাস থেকে এই বিভ্রান্তিকরশিক্ষা আমাদের বিভ্রান্তির দিকে নিপতিতত করতে পারে।
তিনি বলতে চেয়েছেন, স্নেহকুমার চাকমার উদ্ধত স্বভাবের কারণে তদানিন্তন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ডিসি জিএল হাইড ‘মৃত্যৃুকালেও হুল ফুটিয়ে’ দিয়ে গেছেন। এবং এতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের আশা আকাঙ্খা’ ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।

লেখকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি-

” যুবক নেতা স্নেহকুমারচাকমা খুবই মেধাবী কিন্তু উগ্রবাদী ছিলেন। তদানিন্তন ডিসি জি. এল হাইডের সাথেও তার ভাল সম্পর্ক ছিল না। ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান জন্মের ঘোষনারপরে পরেই আনুমানিক রা্ত ১২ টায় প্রশেসন সহকারে স্নেহ কুমার ডিসি জি এল হাইডকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ভারতের পতাকা উত্তোলন করতে বলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তদুপরি যেকোন দেশের জাতীয় পতাকা রাতে উত্তোলন করা অশোভনীয় হলেও স্নেহকুমার পীড়া পিড়ি করতে থাকেন। অন্যদিকে সঙ্গে নেওয়া লোকজনকেও তিনি ক্ষেপিয়ে তুলেন। নিজের ইজ্জ্বত রক্ষার্থে পরের দিন ১৫ আগস্ট ভোরে ডিসি সাহেব পতাকা উত্তোলনের জন্য আসতে বলেন। সহজে বুঝা গেল যে, সেইদিন স্নেহ কুমারের এহেন ব্যবহারের জন্য তিনি অত্যন্ত বিরক্তবোধ করেছেন।”

এই কথা বলার মাধ্যমে লেখক ড. মানিক লাল দেওয়ান বোঝাাতে চেয়েছেন, জি এল হাইডের সাথ অপমানজনক ব্যবহারের কারণেও জি এল হাইড পরে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভৃুক্ত না করানোর জন্য নানাভাবে প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করেছেন!

খুবই তাজ্জ্বব হবার মতো অনুসিদ্ধান্ত বটে!

ভাবতেই জেরবার হতে হয়! একজন সাধারণ জেলা প্রশাসকের সাথে ‘দুর্ব্যবহারের কারণে’ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ইতিহাসের আজকের এই পরিণতি! সাদাচোখে সাধারণ অনেকেরে কাছে এই ‘যুক্তি’ পেটে যে ভালোমতো ঢুকতে তা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়! কিন্তু আমরা বুঝি না, একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি কীভাবে এই যুক্তিকে অন্ধভাবে মেনে নিলেন!?

তিনি তার লেখায় লিখেছেন-

১৫আগস্টের পরে ‘ডিসি জি এল হাইড একদন্ডও আরঅপেক্ষা করলেন না। তিনি তাঁর প্রিয় ঘোড়াটিকে নিজে গুলি করে মারলেনিএবংনিজেই বাংলোর পশ্চিম পার্শ্বে কবর দিলেন। তারপর একটি লঞ্চে করে সোজা চট্টগ্রাম ও পরে কলকাতায় চলে গেলেন। ১৫ আগস্ট ছিল রাঙ্গামাটি থেকে তাঁর চিরবিদায়ের দিন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,কোনপার্বত্য নেতা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাগ্য নির্ধারণে হাইডের সহযোগিতা চাননি। ধারণা করা যায়, হাউড পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যথাস্থানে জোর ওকালতি করেছেন।”

এবং লেখকের এই অনুসিদ্ধান্ত গ্রহণেরপ্রতি আমারও আমাদের তীব্র সমালোচনা এখানে ব্যক্ত করতে হচ্ছে।

তিনি কী জানেন না যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হবার পরিণতি ১৫ আগস্ট বা তার পরে নয়,বরং অরো অনেক আগেই নির্ধারিত হয়েগিয়েছিল?!?

স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ, যিনি ভারত বিভক্তির মূলে ছিলেন, তিনি বেঙ্গল বাউন্ডারী কমিশনের ১২আগস্টের একটি প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ৩ শতাংশ মাত্র মুসলিম ধর্মাবলম্বী। উক্ত প্রতিবেদনে তিনি চট্টগ্রাম জেলার মধ্যেই রেখে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত কথা বলেছিলেন।
তাছাড়া ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে উদ্ধৃত করে প্রকাশিত একটি লেখায়ও বলা হয়েছিল যে, ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে ভারতবর্ষ ভাগ করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ করে ফেলেছিলেন। উক্ত লেখায় তিনি আরো বলেছিলেন, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবংসরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলকে উদ্ধৃত করে ভাইসরয়ের রিফর্ম কমিশিনার ভিপি মেনন তাকে বলেছিলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রতিনিধিদলকে তারা আশ্বস্ত করেছেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানভুক্ত হবে না। এবং এজন্য ১৫আগস্ট স্বাধীনতা ঘোষনারআগে কোন অংশ কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার পুরো বিবরণ দুই নবগঠিতব্য দেশের প্রতিনিধি দলকে না দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়াবলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ,এতে প্রতিনিধি দল বৈঠক বয়কট করতে পারে।
উক্ত প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে যে, ১২ আগস্টেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।


সুতরাং, ডিসি জি এল হাইড অপমানে জর্জরিত হয়ে ১৫ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বেরিয়ে সত্বর দিল্লী পৌছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তদবির করেছিলেন, এই ধরণের গাঁজাখুরি ইতিহাস বা কাহিনী সৃষ্টির চেষ্টা যে কতটা বালসুলভ তা হয়তো আমরা ধারণাই করতে পারি না!


Wednesday, August 2, 2017

তাজউদ্দীন আহমদঃ নতুন আলোকে

সাদাসিধে তাজউদ্দীন আহমদ

তারিখঃ ২২ জুলাই, ২০১৭
তাঁর যখন ৪৫ বা ৪৬ বছর বয়স তখন তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ নেতা। তাঁর কন্যা শারমিন আহমদ যেমনটি বলেছিলেন, তাজউদ্দীন ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক, দূরদর্শী চিন্তার অধিকারী একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, একজন পরিশুদ্ধ চিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি নিজ দায়িত্ব ও কাজে ছিলেন কর্তব্যনিষ্ঠ। তিনি সততাকেই নিজের পুঁজি হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন। এগুলো কথার কথা নয়, তাঁর সারাজীবনের কাজে তিনি এই প্রমাণই রেখে গেছেন।
শারমিন আহমদ লিখেছেন, 'সত্যি শক্তি। সত্য তার আপন বলে বলীয়ান।' এই নীতির একনিষ্ঠ অনুসারী আব্বু লড়েছেন একাকী।' তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ এক লড়াকু, যিনি নিজের জন্য কিছু প্রত্যাশা করেননি। যতদিন এই লড়াকুকে শেখ মুজিব কাছে রাখতে পেরেছেন ততদিন শেখ মুজিব ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপরাজেয়! কিন্তু দেশ স্বাধীন হবারর পরে যেইদিন তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে দূরে সরিয়ে দিলেন, সেইদিন থেকেই যেন তাঁর 'পারমী' বা 'খোদার করুণা' কৃশ আবছা ঝাপসা হতে শুরু করে!
তবে তাজউদ্দীন আহমদ এমন ধাতে গড়া এক মানুষ, যিনি এত সকল কিছুর পরেও, নিজের 'নেতা'র কাছ থেকে এতো অবহেলা, বঞ্চনার শিকার হবার পরেও কোনোকালেই, কোনোসময়েই 'নেতা'র বিপরীতে কোনো অমংগল কাজ করা দূরে থাক, মনেমনেও সেই কামনা করেননি।
এই এক লৌহদৃহ মানবিক মননের অধিকারী ব্যক্তি আজ থেকে ৯২ বছর আগে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুরের কাপাসিয়া দরদরিয়ায় জন্মেছিলেন। ধন্য এমন মানব জনম, সার্থক এমন জীবন যাপন!
এই ব্যক্তি, যিনি মনেপ্রাণে ছিলেন এই দেশেরই বৃহত জাতির একজন, বাঙালি। আবেগে চিন্তায় তিনি ছিলেন খাঁটি আদর্শবান অনুসরনীয় একজন 'বাঙালি'ই, তবে একইসাথে মানবতাবাদীও। কিন্তু, অত্যন্ত বেদনার যে,
আজ বৃহত 'বাঙালি' জাতিগোষ্ঠির মধ্যে এই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে ভাবার মতো নেই কেউ, তাঁর আদর্শকে তুলে ধরে অনুসরনীয় হবার মতোও নেই এমন কোনো অনুসরনীয় কোনো ব্যক্তিত্ব!
তিনি বলেছিলেন, ‘শুধু ভালো বক্তৃতা করে দেশের মানুষের মঙ্গল করতে পারবেন না। বক্তৃতা সত্যি হতে হবে। মানুষের সত্যিকার অবস্থা আগে তুলে ধরে তারপর প্রকৃত নির্দেশ দিতে হবে। এর নাম নেতৃত্ব। এটা খুবই কষ্টকর। কিন্তু সত্যিকার খায়েশ যদি হয়ে থাকে তা হলে তা করতে হবে। কিন্তু এছাড়া শুধু বক্তৃতা করে বেশি দিন নেতৃত্ব করা যাবে না।’(সূত্রঃ শুভ কিবরিয়া, বাংলা ট্রিবিউন)
আজকাল কথা বলার লোক বা ভুরি ভুরি ভালো ভালো কথা লেখার লোক তো কম পাওয়া যায় না! বরং ভালো ভালো কথা বেশিই যেন বলা হয়ে থাকে, লেখা হতে থাকে! টিভি টকশো'তে চোখ কান দিলেই তা গোচরীভূত হতে থাকে!
আজ ২৩ জুলাই ২০১৭ পর্যন্ত যদি তাজউদ্দীন বেঁচে থাকতেন তবে তাঁর বয়স হতো ৯২। এই বয়সেও অনেকেই বেঁচে থাকেন। শুনেছি মালয়েশিয়ার মাহাথির মুহাম্মদ এই বয়সে আবার রাজনীতিতে নাকি আসতে চাইছেন।
কিন্তু, তাজুদ্দীন ৫০ পেরোতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ২২ তারিখ তাঁকে আটক করা হয়। একই বছরের ৩ নভেম্বর আরো তিন নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ তাজউদ্দীনকে কারাগারে খুন করা হলো নির্মমভাবে।
শেখ মুজিব খুন হবার পরে তিনি নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু 'অপবাদ' মাথায় নিয়ে তিনি পালিয়ে যেতে চাননি। তবে তিনি যদি পালিয়ে যেতেন, রক্ষা করতেন নিজেকে, তিনি যদি আবার হাল ধরতেন দেশ গঠনের কাজে, তবে দেশের ইতিহাস কি অন্যভাবে লিখতে হতো?
যা হয়নি, তা হবার নয়। তাই ও কথা তোলা থাক অগোছালো!
এই সত্যটিই আজ প্রকটিত হয়ে আমাদের শিক্ষা দিক যে, 'নেতা যখন অসৎ, অযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ণ ও সুবিধাবাদীদের কাছে টেনে নেন এবং তাদের প্রশ্রয় দেন তখন ভয়াবহ পরিণাম শুধু তার ভাগ্যেই ঘটে না, পুরো জাতিকেই তার মাশুল দিতে হয়। জাতি পিছিয়ে যায় শত বছর।'(তাজউদ্দীন আহমদ, নেতা ও পিতা; পৃঃ ১৭৫; শারমিন আহমদ)
তবে নেতা বা নেতৃত্ব যখন জাতীয় উত্তুঙ্গ উত্তাল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে সঠিক দিশা হাজির করে নেতৃত্ব দিতে অপারগ হন বা সঠিক ভুমিকা রাখতে সমর্থ না হন, তবে তখনও একটি জাতিকে, একটি জাতিগোষ্ঠি ও একটি অঞ্চলের জাতিসমষ্টিকে মাশুল গুণতে হয়, পিছিয়ে যেতে হয় আরো বহু বছর।

সর্বাধিক পঠিত

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষাঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসংগ-১৯৪৭ সাল

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষা তারিখঃ ১৬ আগস্ট, ২০১৭ ইতিহাস একটি জাতি বা জাতিসত্তা তথা জাতিসমষ্টিকে নানাভাবে প্রভাবিত কর...