Wednesday, August 2, 2017

তাজউদ্দীন আহমদঃ নতুন আলোকে

সাদাসিধে তাজউদ্দীন আহমদ

তারিখঃ ২২ জুলাই, ২০১৭
তাঁর যখন ৪৫ বা ৪৬ বছর বয়স তখন তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ নেতা। তাঁর কন্যা শারমিন আহমদ যেমনটি বলেছিলেন, তাজউদ্দীন ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক, দূরদর্শী চিন্তার অধিকারী একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, একজন পরিশুদ্ধ চিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি নিজ দায়িত্ব ও কাজে ছিলেন কর্তব্যনিষ্ঠ। তিনি সততাকেই নিজের পুঁজি হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন। এগুলো কথার কথা নয়, তাঁর সারাজীবনের কাজে তিনি এই প্রমাণই রেখে গেছেন।
শারমিন আহমদ লিখেছেন, 'সত্যি শক্তি। সত্য তার আপন বলে বলীয়ান।' এই নীতির একনিষ্ঠ অনুসারী আব্বু লড়েছেন একাকী।' তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ এক লড়াকু, যিনি নিজের জন্য কিছু প্রত্যাশা করেননি। যতদিন এই লড়াকুকে শেখ মুজিব কাছে রাখতে পেরেছেন ততদিন শেখ মুজিব ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপরাজেয়! কিন্তু দেশ স্বাধীন হবারর পরে যেইদিন তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে দূরে সরিয়ে দিলেন, সেইদিন থেকেই যেন তাঁর 'পারমী' বা 'খোদার করুণা' কৃশ আবছা ঝাপসা হতে শুরু করে!
তবে তাজউদ্দীন আহমদ এমন ধাতে গড়া এক মানুষ, যিনি এত সকল কিছুর পরেও, নিজের 'নেতা'র কাছ থেকে এতো অবহেলা, বঞ্চনার শিকার হবার পরেও কোনোকালেই, কোনোসময়েই 'নেতা'র বিপরীতে কোনো অমংগল কাজ করা দূরে থাক, মনেমনেও সেই কামনা করেননি।
এই এক লৌহদৃহ মানবিক মননের অধিকারী ব্যক্তি আজ থেকে ৯২ বছর আগে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুরের কাপাসিয়া দরদরিয়ায় জন্মেছিলেন। ধন্য এমন মানব জনম, সার্থক এমন জীবন যাপন!
এই ব্যক্তি, যিনি মনেপ্রাণে ছিলেন এই দেশেরই বৃহত জাতির একজন, বাঙালি। আবেগে চিন্তায় তিনি ছিলেন খাঁটি আদর্শবান অনুসরনীয় একজন 'বাঙালি'ই, তবে একইসাথে মানবতাবাদীও। কিন্তু, অত্যন্ত বেদনার যে,
আজ বৃহত 'বাঙালি' জাতিগোষ্ঠির মধ্যে এই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে ভাবার মতো নেই কেউ, তাঁর আদর্শকে তুলে ধরে অনুসরনীয় হবার মতোও নেই এমন কোনো অনুসরনীয় কোনো ব্যক্তিত্ব!
তিনি বলেছিলেন, ‘শুধু ভালো বক্তৃতা করে দেশের মানুষের মঙ্গল করতে পারবেন না। বক্তৃতা সত্যি হতে হবে। মানুষের সত্যিকার অবস্থা আগে তুলে ধরে তারপর প্রকৃত নির্দেশ দিতে হবে। এর নাম নেতৃত্ব। এটা খুবই কষ্টকর। কিন্তু সত্যিকার খায়েশ যদি হয়ে থাকে তা হলে তা করতে হবে। কিন্তু এছাড়া শুধু বক্তৃতা করে বেশি দিন নেতৃত্ব করা যাবে না।’(সূত্রঃ শুভ কিবরিয়া, বাংলা ট্রিবিউন)
আজকাল কথা বলার লোক বা ভুরি ভুরি ভালো ভালো কথা লেখার লোক তো কম পাওয়া যায় না! বরং ভালো ভালো কথা বেশিই যেন বলা হয়ে থাকে, লেখা হতে থাকে! টিভি টকশো'তে চোখ কান দিলেই তা গোচরীভূত হতে থাকে!
আজ ২৩ জুলাই ২০১৭ পর্যন্ত যদি তাজউদ্দীন বেঁচে থাকতেন তবে তাঁর বয়স হতো ৯২। এই বয়সেও অনেকেই বেঁচে থাকেন। শুনেছি মালয়েশিয়ার মাহাথির মুহাম্মদ এই বয়সে আবার রাজনীতিতে নাকি আসতে চাইছেন।
কিন্তু, তাজুদ্দীন ৫০ পেরোতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ২২ তারিখ তাঁকে আটক করা হয়। একই বছরের ৩ নভেম্বর আরো তিন নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ তাজউদ্দীনকে কারাগারে খুন করা হলো নির্মমভাবে।
শেখ মুজিব খুন হবার পরে তিনি নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু 'অপবাদ' মাথায় নিয়ে তিনি পালিয়ে যেতে চাননি। তবে তিনি যদি পালিয়ে যেতেন, রক্ষা করতেন নিজেকে, তিনি যদি আবার হাল ধরতেন দেশ গঠনের কাজে, তবে দেশের ইতিহাস কি অন্যভাবে লিখতে হতো?
যা হয়নি, তা হবার নয়। তাই ও কথা তোলা থাক অগোছালো!
এই সত্যটিই আজ প্রকটিত হয়ে আমাদের শিক্ষা দিক যে, 'নেতা যখন অসৎ, অযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ণ ও সুবিধাবাদীদের কাছে টেনে নেন এবং তাদের প্রশ্রয় দেন তখন ভয়াবহ পরিণাম শুধু তার ভাগ্যেই ঘটে না, পুরো জাতিকেই তার মাশুল দিতে হয়। জাতি পিছিয়ে যায় শত বছর।'(তাজউদ্দীন আহমদ, নেতা ও পিতা; পৃঃ ১৭৫; শারমিন আহমদ)
তবে নেতা বা নেতৃত্ব যখন জাতীয় উত্তুঙ্গ উত্তাল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে সঠিক দিশা হাজির করে নেতৃত্ব দিতে অপারগ হন বা সঠিক ভুমিকা রাখতে সমর্থ না হন, তবে তখনও একটি জাতিকে, একটি জাতিগোষ্ঠি ও একটি অঞ্চলের জাতিসমষ্টিকে মাশুল গুণতে হয়, পিছিয়ে যেতে হয় আরো বহু বছর।

No comments:

Post a Comment

সর্বাধিক পঠিত

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষাঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসংগ-১৯৪৭ সাল

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষা তারিখঃ ১৬ আগস্ট, ২০১৭ ইতিহাস একটি জাতি বা জাতিসত্তা তথা জাতিসমষ্টিকে নানাভাবে প্রভাবিত কর...