জেনারেল ভো নগুয়েন গিয়াপ মারা গেলেন ১০২ বছর বয়সে। গত শুক্রবার ০৪ অক্টোবর, ২০১৩ ভিয়েতনামের হ্যানয়ের এক সামরিক হাসপাতালে তিনি মারা যান। তাকে নিয়ে তার জীবন নিয়ে আমার সংক্ষিপ্ত একটি লেখা।
তাকে বিবেচনা করা হয় ইতিহাসের অন্যতম একজন সমর বিষয়ক কলাকুশলবিদ হিসেবে। ফ্রান্স ও আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদকে ভিয়েতনাম থেকে হটিয়ে দিতে তিনি সামরিকভাবে ভিয়েতনাম বিজয়ের ক্ষেত্রে স্থপতির মতো ভূমিকা রেখেছিলেন।
ভিয়েতনামে হো চি
মিনের পর দ্বিতীয় নেতা হিসেবে তিনি বিবেচিত হন। তিনি আক্ষরিকভাবে বা
আনুষ্ঠানিকভাবে কোন সামরিক প্রশিক্ষণ নেননি। কিন্তু ভিয়েতনামের সশস্ত্র
বিপ্লবী গেরিলা যুদ্ধের তিনি ছিলেন সর্বাধিনায়ক। তিনি প্রথম সামরিক বিষয়ে
পাঠের হাতেখড়ি ছিলো হ্যান্ড গ্রেনেডের মেকানিজম বিষয়ে একটি এনসাক্লেপেডিক
এন্ট্রি থেকে।
১৯১১(মতান্তরে ১৯১২) সালের ২৫ আগস্ট তিনি উত্তর ভিয়েতনামের কুয়াঙ বিন প্রদেশের আন জা নামে এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম ভো কুয়াঙ নিঘিয়েন(Vo Quang Nghiem)। তার পিতা ছিলেন একজন শিক্ষাজ্ঞানসম্পন্ন একজন কৃষক এবং একজন জাতীয়তাবাদী। তিনি তার পুত্র ভো নগুয়েন গিয়াপকে ফ্রান্স সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। অর্থাৎ, ছোটকাল থেকেই তিনি সংগ্রামী আবহে বেড়ে উঠেছিলেন।
তাই যুব বয়স থেকেই গুপ্ত জাতীয়তাবাদী সংগঠনে যোগ দেন।
গিয়াপ ১৯৩৭ সালে হ্যানয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের উপর লেখাপড়া করেছিলেন। একই সাথে তিনি থান লঙ স্কুল নামে একটি স্কুলে শিক্ষকতাও করতেন। সেখানে তিনি ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। তিনি সেখানে খুবই প্রাণবন্তভাবে ফ্রান্সের ঐতিহাসিক বিপ্লব নিয়ে ছাত্রদের বোঝাতেন বলে জানা যায়।
তার নেপোলিয়নের সামরিক কলাকৌশল সম্পর্কেও বিশেষ ধারণা ছিলো। তার একজন ছাত্র স্মরণ করে বলছিলেন যে, তিনি ফ্রান্সের এই অধিপতির নানা যুদ্ধ পরিকল্পনা স্মরণ করে বলে দিতে পারতেন।
এঝাড়া তিনি তখন লেনিন, মার্ক্সের লিটারেচার পড়তেন। মাও সেতুঙের রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল নিয়েও তিনি লেখাপড়া করেছেন। তিনি সে সময়ে আন্ডারগ্রাউন্ড জার্নালিস্ট হিসেবেও কাজ করেছিলেন। তিনি ফ্রেঞ্চ ভাষা অনর্গল বলতে পারতেন।
ভিয়েতনাম কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য
১৯৩৮ সালে তিনি হো চি মিনের ইন্দোচীন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৩৯ সালে তিনি পালিয়ে চীনে যান। সেখানে তিনি হো চি মিনের সাথে দেখা করেন।
১৯৪১ সালের মে মাসের দিকে হো চি মিনের নেতৃত্বে এক বৈঠকে বিভিন্ন সংগ্রামীদের নিয়ে যুক্তভাবে ভিয়েতমিন নামে সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এর পূর্ণাঙ্গ নাম ছিলো ভিয়েতনাম ডক লাপ ডং মিন হোই বা ইংরেজিতে League for the Independence of Vietnam। এই বৈঠক থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঠিক করা হয়, সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা হবে, বিপ্লবী ঘাঁটি গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে, বিপ্লবের কাজ দ্রুততার সাথে এগিয়ে নিতে হবে এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে।
গিয়াপ সামরিক বাহিনী গঠন করতে ভূমিকা গ্রহণ করেন। এবং তিনি জাপানী দখলদারদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে ১৯৪৪ সালে ইন্দোচীনে ফিরে আসেন।
তিনি গেরিলা পদ্ধতিতে অর্থাৎ, হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে লড়াই শুরু করেন। গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধ সম্পর্কে তিনি তার এক লেখায় লেখেন-
গেরিলা যুদ্ধ হচ্ছে উন্নততর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অস্ত্রশস্ত্রে দিক থেকে সুসজ্জিত একটি আগ্রাসী সেনাদলের বিরু্দ্ধে একটি নিপীড়িত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ এক দেশের ব্যাপক জনসমষ্টির প্রতিরোধ সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে প্রত্যেক গ্রামবাসীই হচ্ছে এক একজন যোদ্ধা, এবং গ্রামগুলো হচ্ছে দুর্গের মতো।
ফ্রান্সের পরাজয়(ভিয়েতনামের বিপ্লবী বাহিনী কর্তৃক ফ্রান্সের পরাজয়)
১৯৪৫ সালের ০২ সেপ্টেম্বর হো চি মিন গণ প্রজাতন্ত্রী ভিয়েতনাম গঠনের ঘোষনা প্রদান করেন। এং গিয়াপ অভ্যন্তরীন মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগলাভ করেন।
ভিয়েতনাম দেশকে ফ্রান্স স্বীকৃতি দিলো। কিন্তু দেশের দক্ষিণ দিকের চাল ও রাবারের উৎসের উপর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে গড়িমসি করলো। এজন্য আন্তর্জাতিক ব্যবসার উপর ট্যারিফ বা শুল্ক আরোপ করলো।
কম্যুনিস্ট পার্টি প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করলো। গিয়াপ হাজার হাজার গেরিলা যোদ্ধাকে টংকিং পাহাড়ে সংগঠিত করলো এবং ফ্রান্সের বাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হলো সশস্ত্র গেরিলা পদ্ধতির লড়াই।
ফ্রান্স লাওসের সীমান্তের কাছে ভিয়েতনামের দিয়েন বিয়েন ফু নামক জায়গায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করলো। সেখানে ১৩ হাজারের অধিক সৈন্যের সমাবেশ ঘটালো। ফ্রান্স এভাবে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে নিজের কর্তৃত্বকে নিরাপদ মনে করেছিল। কিন্তু এই নিরাপদ সেনা ঘাঁটিতেই গিয়াপ চালালো ব্যাপক আক্রমণ।
গিয়াপ আমেরিকার তৈরী ভারি মেশিনগান সংগ্রহ করেছিল তা ফ্রেঞ্চ বাহিনীর জানা ছিলো না। গিয়াপ তা পাহাড়ের উপর স্থাপন করলো, নিচের শত্রু ঘাঁটিতে তাক করে রাখলো।
ফ্রেঞ্চ বাহিনী ভ্যালীর ভেতরে আটকা পড়ে রইলো। টানা ২ মাস হামলার সহ্য করার পরে এবং ৪০০০ হাজার সৈন্য হারাবার পরে ১৯৫৪ সালের মে মাসের ৭ তারিখ ফ্রেঞ্চ বাহিনী পরাজয় মেনে নিলো। এবং এই পরাজয় ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি টানার বার্তা দিলো।
গিয়াপ দিয়েন বিয়েন ফু-য়ের লড়াই নিয়ে বলেছিলেন- পশ্চিমের জন্য এটি ছিলো প্রথম দুঃসহ এক পরাজয়। এটি উপনিবেশের ভিত নাড়া দিয়েছিলো এবং জনগণকে মুক্তির যুদ্ধে শরীক হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এটি ছিলো আন্তর্জাতিকাবাদী সভত্যার সূচনা বিন্দু।
ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রায় ৩ লাখ ভিয়েতনামী মারা যায়। ফ্রান্সের পক্ষে মারা যায় ৯৪ হাজার।
ভিয়েতনামে নতুন করে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপ
১৯৫৪ সালে যুদ্ধ বিরতি স্বাক্ষরিত হলো। এতে ভিয়েতনাম দুইভাগে ভাগ হলো। এই যুদ্ধবিরতি মতে গণভোটের মাধ্যমে ভিয়েতনামের ভবিষ্যত ঠিক করার কথা।
কিন্তু গণভোট অনষ্ঠিত হলো না । দক্ষিণ ভিয়েতনামকে কব্জায় রাখতে ফ্রান্স ও আমেরিকা সেখানে পুতুল এক সরকার বসালো। এরই প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিনের জাতীয়তাবাদীরা গঠন করলো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট যা আমেরকিার সৈন্যদের কাছে ভিয়েত কঙ নামে পরিচিত ছিলো। উত্তর ভিয়েতনামের সহায়তায় দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রতিরোধ সংগ্রামে গতিবেগ বৃদ্ধি পেলো।
তখন দক্ষিণ ভিয়েতনামে আমেরিকার সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা ১৬ হাজারের উর্দ্ধে ছিলো।
এই দুর্বার গতি দেখে আমেরিকা ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাথে এক আঁতাত গড়ে তুলে সরাসরি ভিয়েতনামে হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করলো।
দক্ষিণ ভিয়েতনামে কম্যুনিস্টদের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় আমেরিকা দক্ষিনের প্রশাসনকে সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান শুরু করলো।
১৯৬৫ সালে ভিয়েতনামে আমেরিকান বাহিনী অবতরণ করলো। এবার গিয়াপ উত্তরের বাহিনীকে দক্ষিনের ভিয়েত কঙ বাহিনীকে সহযোগিতা করার ব্যবস্থা করলো।
গিয়াপ বিশ্বাস করতেন, ভিয়েতনামে আমেরিকার প্রলম্বিত যুদ্ধ করার সামর্থ্য নেই। তিনি বলতেন-প্রলম্বিত যুদ্ধ মানেই তাদের জন্য বিরাট পরাজয়।তাদের নৈতিক বল ঘাসের চেয়ে নিচে।
টেট নগুয়েন ডান বা ভিয়েতনাম লুনার নিউ ইয়ারের প্রতিরোধ
ভিয়েতনাম আমেরিকার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে।
লনার নববর্ষ বা টেট এর মিল রেখে ১৯৬৮ সালে ভিয়েত কঙ এবং ভিয়েতনামের উত্তর অঞ্চলের বাহিনী একসাথে ৪০টির বেশি প্রদেশের রাজধানীতে আক্রমণ করলো। তারা সায়গনে ঢুকে গেল এবং এমনকি আমেরকিান এম্বেসিতেও প্রবেশ করলো।
তবে ১৫ হাজার সৈন্য মারা যাবার পরে আমেরিকান বাহিনী ঘটনাক্রমে তাদের পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই হামলা আমেরিকার জন্য মানসিক দিক থেকে একটি বিরাট ধাক্কা। এ কারণে তাদেরযুদ্ধ থেকে পশ্চাদপসর করে আমেরিকায় ফিরে আসতে বাধ্য হতে হয়। প্রায় ৮০ হাজার ভিয়েতনামী যোদ্ধা এই যু্দ্ধে অংশ নেয়।আতার মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার যোদ্ধা হয় আহত হয় বা নিহত হয়।
পরের বছর থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকান সৈন্য সরিয়ে নেয়া শুরু করেন।
গিয়াপের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভিয়েতনাম দখল করা সম্ভব হয় ৩০ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে। সায়গনে আমেরিকার পুতুল সরকারের পতন ঘটে।
এরপর সোস্যালিস্ট রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম গঠনের ঘোষনা প্রদান করা হয়।
এক হিসাব মতে আমেরিকা এই যদ্ধে তাদের ৫৮ হাজার সেনা সদস্যকে হারায়। ভিয়েতনামের পক্ষ থেকে শহীদ হন মোট ২৫ লাখের অধিক। ভিয়েতানামে তখন জনসংখ্যা ছিলো ৩কোটি ২০ লাখের মতো।
সংগ্রামী ও বিপ্লবীর জীবনাবসান
স্যোসালিস্টভিয়েতনাম গঠিত হবার পরে গিয়াপ প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এবং ১৯৭৬ সালে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি ৬বছর পরে দায়িত্ব থেকে অবসর নেন।
তিনি সামরিক স্ট্রাটেজির উপর কিছু বই লেখেন। এবং কমপক্ষে একজন ইতিহাসবিদ তাকে ওয়েলিংটন, রোমেল এবং ম্যাক আর্থারের মত নেতাদের সমকক্ষ হিসেবে তুলনা করেন।
সৈন্যবাহিনীকে উজ্জ্বীবিত করার সামর্থ্যের জন্য তার বাহিনীর সৈন্যদের কাছে তিনি “অগ্নিগিরি” হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু এই নামটি বিশ্ব পরিচিতি পায়নি।
তিনি মারা গেলেন ১০২ বছর বয়সে। ০৪ অক্টোবর ২০১৩ সালে। তার প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন ফ্রান্সের কারাগারে। তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী বিয়ে করেন ১৯৪৯ সালে। তার নাম ডাঙ বিক হা। তার ৪ সন্তান রয়েছে।
সংগ্রামী জীবন বেছে নেয়া বিষয়ে জেনারেল গিয়াপ এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, যখন আমি তরুন-যুবক ছিলাম তখন আমি স্বপ্ন দেখতাম একসময় আমাদের দেশ মুক্ত হবে এবং আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো। এবং আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
স্বপ্ন পূরণ হবার পরে্ অনেক বছর বেঁচে থাকার পরে সমাপ্ত হলো বর্ণাঢ্য এবং বিশ্বে আলোচিত এক জীবনের।
তথ্যসূত্র:
১. http://www.thanhniennews.com
২. http://www.nytimes.com
৩. http://www.bbc.co.uk
No comments:
Post a Comment