বইটি তেমন বড় নয়, মাত্র একশ’ দুই পৃষ্ঠার। আর ঘটনা যে তেমন আছে তাও নয়। মাত্র কয়েকটি ঘটনার সমাহার। তবে এইসব ঘটনা জাতীয় জীবনের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত। দেশের ইতিহাসের অংশ এইসব ঘটনা। এই সকল ঘটনাবলী যা ছিল অপ্রকাশিত সাধারণের মাঝে সেগুলো আজ লেখকের লেখায় প্রকাশিত হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
ব্রিগেডিয়ার শামসুদ্দীন আহমেদ, একজন সেনা কর্মকর্তা। তিনি একসময় বেশ কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ভবন বঙ্গভবন-এ চাকরিসূত্রে অবস্থান করেছিলেন। সেখানে তিনি যা দেখেছেন, যেভাবে ঘটনাবলীকে বিশ্লেষণ করেছেন তা-ই আমরা তাঁর লেখায় দেখতে পাই। বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন প্রখ্যাত লেখক ও শিক্ষক কবীর চৌধুরী। মুখবন্ধের প্রথম অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন- প্রাসঙ্গিকভাবে লেখক নানা বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা বিভিন্ন রুচির পাঠককে বিভিন্নভাবে আকৃষ্ট করবে। লেখক-পরিবেশিত বঙ্গভবন নির্মাণের ইতিহাস, স্থাপত্যকৌশল, বিভিন্ন কক্ষের বর্ণনা, সাজ-সরঞ্জাম, বঙ্গভবনের অতিথি-আপ্যায়ন এবং সেখানে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সরকারী ও আধাসরকারী অনুষ্ঠানাদির কথা ও আরো অনেক বিষয় কৌতূহলী পাঠককে তৃপ্ত করবে।
তিনি মুখবন্ধে লেখকের বিভিন্ন ঘটনার আরো অনেক বিষয় তিনি আলতো স্পর্শ করেছেন। তার মধ্যে জেনারেল এরশাদ ও তার স্ত্রী রওশন এরশাদের ‘পুত্রসন্তান লাভ, বঙ্গভবনের করিডোরের দেয়ালে নানাজনের ছবি থাকলেও শেখ মুজিবর রহমানের ছবি নেই, ‘হীন অনুকরণপ্রিয়তা’র কথা ইত্যাদি তিনি তুলে ধরেছেন।
এছাড়া এই বই পড়ে জানতে পারবেন একজন রাষ্ট্রপতি কিভাবে সামরিক আইন প্রশাসকের তল্পিবাহক হয়ে যান, জানতে পারবেন মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসে ইফতার আমন্ত্রণ নিয়ে জনগণের টাকায় বিলাসিতার কথা, অনেক নাম না জানা ব্যক্তির ক্ষমতার প্রতি মোহ, অর্থের প্রতি লোভ ইত্যাদির কথা। এবং একই সাথে নিশ্চয়ই অবিচল চারিত্রবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের কথাও এতে পাবেন।
তবে আমার কাছে সেগুলো সাধারণ তথ্য হিসেবে মনে হয়েছে। লেখক অভিজ্ঞতা বর্ণনাসূত্রে সেসকল তুলে ধরেছেন। কিন্তু তার বই ঘটনার বর্ণনার চেয়ে বেশি। এখানে ঘটনার বর্ণনা গৌণ হয়ে যায় যখন তাঁর উদ্দেশ্য আমরা জানতে পারি। লেখক বইয়ের ভূমিকা অংশে যা লিখেছেন তা তুলে ধরছি-
সেই ধ্যান-ধারণা থেকেই তিনি তার কর্মজীবনে অন্যায় দেখেছেন, দেখেছেন লোভ লালসা, ক্ষমতার মোহ, চাটুকারিতা। তবে তিনি তারপরেও নিজের নীতি নৈতিকতাবোধে অবিচল থেকেছেন। ব্যক্তির স্বার্থ না ভেবে ভাবতে চেযেছেন দেশের কথা, নীতির কথা, এথিকসের কথা, দায়িত্ববোধের কথা।
তিনি বলছেন-
তিনি ব্যক্তিগতভাবে তার চাকুরি জীবনে এই ধরনের ‘মন মানসিকতা’কে লালন করেননি বলে দাবি করেছেন।
তিনি তাঁর লেখায় তাঁর দৃষ্টিতে ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দ ইত্যাদির বর্ণনা করেছেন। তিনি তাঁর বইয়ে লেখার শেষে যা মন্তব্য করেছেন সে দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি মহৎ আদর্শের কথা তিনি বলতে চেয়েছেন। তাঁর বইয়ের শেষ বাক্যটি হল-
ভূমিকা অংশে তিনি লিখেছেন-
তিনি তাঁর বইয়ে যে ঘটনাবলীর বর্ণনা করেছেন তা তাঁর এই মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই করেছেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে যা দেখেছেন তার মূল্যায়ন করতে চেয়েছেন। আগামী দিনে যারা দেশের সত্যিকার ভাল মহৎ কিছু করার স্বপ্ন দেখেন ও তার বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবেন তারা যেন এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে সে চেষ্টাই তিনি করেছেন। ১৯৯২ সালে লেখা এবং ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তার এই বই হয়তো নানা কারণে আরো অনেকের কাছে পৌঁছায়নি। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এই বই হল তাদের জন্য যারা দেশের ভাল কিছু করার জন্য আপ্রাণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই বই পড়ে দেশের শাসনকামীরা উদ্বুদ্ধ হতে পারবেন মহৎ কিছু করতে। এই বই আরো অনেক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করুক এই প্রত্যাশা রইল।
সত্যিকারের ভাল মনের মানুষ এবং একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লেখক বা মানুষের লেখা পড়লে আমরা সবাই উপকৃত হবো এই প্রত্যাশা। বইটির নাম ‘যখন বঙ্গভবনে ছিলাম’। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী। প্রথম প্রকাশ- ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩। বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা- ১০২।
No comments:
Post a Comment