তারিখঃ ০৪ জুন, ২০১৭
[ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বিষয়ে এই মূল্যায়ন নিশ্চয়ই আমাদের ভাবতে শেখাবে এই প্রত্যাশা রেখে লেখাটি ফেসবুকে শেয়ার করলাম]
মোট ১১ টি বাংলা পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণের ০৩ জুন, ২০১৭ প্রকাশিত সংখ্যায় লুঙুদু সাম্প্রায়িক হামলা বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সাধারণ পর্যালোচনামূলক সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে করা হয়েছে। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বোঝা যায়, পত্রিকার প্রতিবেদক বা রিপোর্টারগণ কেউই লুঙুদুর মূল ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তথ্য সংগ্রহ করেননি। তাই দেখা গেছে, আসলে কী ঘটনা ঘটেছে তা সংগ্রহ করতে অনেকেই সোর্স হিসেবে ফেসবুককেই ব্যবহার করেছেন। এতে প্রতিবেদন প্রণয়ন করতে মারাত্মক ত্রুটি দেখা গেছে।
বিশেষ করে গাজীপুরে ব্রয়লার বিস্ফোরণের একটি ছবি লুঙুদু’র ঘটনা হিসেবে ফেসবুকে কে বা কারা শেয়ার করার পরে সেই ছবি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় মূল হেডিঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া বেশ কয়েকটি পত্রিকা সেই ছবিটি ব্যবহার করেছে। এতে প্রশ্ন থেকে যায়, রাঙামাটি জেলার লুঙুদুতে কোনো পত্রিকারই কি কোনো প্রতিনিধি নেই? তারা কি এই গুরুতর ত্রুটি ধরিয়ে দিতে পারেননি? অথবা নাকি অসাবধানতাবশতঃ না হয়ে এই ত্রুটিকে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে? খেয়াল করা গেছে গাজীপুরের ব্রয়লার বিস্ফোরণের এই ছবিটি প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় লীড কলাম আকারে ছাপা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে দৈনিক আমাদের সময়ের শেষ পৃষ্ঠায়। ব্যবহার করা হয়েছে যায়যায়দিন পত্রিকার শেষ পাতায়। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায়ও এই ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া সমকাল পত্রিকায় ব্যবহার করা হয়েছে বলে বলে জেনেছি। প্রতিষ্ঠিত এই সকল পত্রিকার রাঙামাটি জেলা প্রতিনিধি যারা রয়েছেন তাদের নিশ্চয়ই লুঙুদু উপজেলারও প্রতিনিধি বা পরিচিত কেউ থাকার কথা। যখন এই ছবিটি পত্রিকায় ব্যবহার করা হচ্ছে তখন তারা এই ছবিটি ভ্যারিফাই কেন করেননি তা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে থাকলো। অথবা জেনেশুনেই এই ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা তাও এখন প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে যাবে বলেই আশংকা প্রকাশ করতে হচ্ছে। হয়তোবা ঘটনার মাত্রা নিয়ে বা ঘটনা নিয়ে যাতে প্রশ্ন করা যায় সে দিকটি মাথায় রেখে এই ’কাঁচা ভুল’ যে জেনেশুনে করা হয়নি তা-ই বা কে বলতে পারে?!
পত্রিকার প্রতিবেদনের দিকে খেয়াল রাখলে বোঝা যায় ১১ টি প্রতিবেদন আলাদা আলাদা মনে হলেও মূলত, দুএকটি বাদে বাকি সকল প্রতিবেদনের মূল সূত্র বা মূল লেখক বা মূল তথ্যদাতা বা মূল তথ্য সংগ্রহকারী সম্ভবত দুইজন বা তিনজন হতে পারেন। তাদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করার পরে প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং পরে তার দুএকটি বাক্য বা বাক্যাংশ বা প্যাটার্ন বদল করে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিবেদনসমূহ পড়ে ভাষাগত ও বানানগত নানা ভুল সহজেই চোখে পড়ে। বিশেষ করে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রথম অংশেই এই ভুলচুক বেশি উৎকটভাবে দৃশ্যমান।
প্রতিবেদনসমূহ পড়ে আমি তিনটি ক্যাটাগরিতে প্রতিবেদনসমূহ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। তাতে দেখা গেছে, ক্ষয়ক্ষতির বিবরণে প্রশাসনের সূত্র থেকে ১০/১২টির বেশি বলা হয়নি। তবে একটি বেসরকারী সূত্র থেকে ৮৬টির মতো ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পাহাড়িদের পক্ষ থেকে ২০০ বা আড়াইশ বা তারও অধিক বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ার দাবি করা হয়েছে। এবং এতে প্রায় সকল পত্রিকায় জনসংহতি সমিতি লুঙুদু উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মনিশংকর চাকমার উদ্ধৃতি দিয়ে বাড়িঘর পুড়ে যাবার সংখ্যাটি বলা হয়েছে।
প্রশাসনের বক্তব্য সাধারণভাবে গতানুগতিক হয়ে থাকে। এতে সাধারণত, পুড়ে যাবার ঘটনা স্বীকার করা হলেও কম পুড়ে যাবার কথা স্বীকার করা হয়। তাছাড়া ঘটনার জন্য আদতেই দোষী কোন অংশ তা জানার পরেও জটিলতা এড়ানোর জন্য দোষী কোন অংশ তা স্পষ্ট করে বলা হয় না। এখানেও আমরা সেই প্রবণতা দেখতে পাই। অন্যতম জাতীয় একটি দৈনিকে বলা হচ্ছে ’পাহাড়ি বাঙালি সমস্যার কারণে’ ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
তবে দুএকটি পত্রিকায় উদ্ধৃতিসমূহ পাঠ করে সহজেই বোঝা যায় ঘটনার মূল অংশ কে বা কারা ছিল। এক্ষেত্রে আমরা দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মমিনুল ইসলামের বিবরণ উদ্ধৃত করতে পারি। তাকে উদ্ধৃত কওে বলা হচ্ছে- তিনি ’.. ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, নয়নের লাশ নিয়ে র্যালি করে আসার পথে কিছু লোক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায়। এ সময় পুলিশসহ যৌথবাহিনী ও প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ায় পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে’। এতে দেখা যায় মিছিল করার সময়ই কিছু লোক ’অপ্রীতিকর’ভাবে হামলা করেছে ও পাহাড়িদের বাড়িঘরে নির্বিচারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় বলা হয়েছে- ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা থাকলেও তাঁরাও নিরুপায় হয়ে পড়েন। অর্থাৎ, ঘটনা ঘটার সময়ে আইন শৃংখলা বাহিনী উপস্থিত ছিল। তবে তাদের ভুমিকা রাখার মতো পরিস্থিতি সেখানে ছিল না। কিন্তু পাহাড়ি জনগণের পক্ষ থেকে বিভিন্নজনের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খবরে আমরা দেখতে পাই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ভুমিকা নিরপেক্ষ না থেকে সাপেক্ষে যেন তারা একটি পক্ষের দিকে বেশি ঝুঁকে গেছেন!
পত্রিকাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি একপেশে ও পাহাড়ি বিদ্বেষী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা। লংগদুতে অনুষ্ঠিত সমাবেশের খবরে বক্তাদের উদ্ধৃত করে উক্ত পত্রিকায় বলা হয়েছে- ’সমাবেশে বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করার জন্যে পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলো ধারাবাহিকভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়- এনিয়ে গত কয়েকমাসের ব্যবধানে পাহাড়ে তিনজন মোটর সাইকেল চালককে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। প্রতিবেদনে পাহাড়ি জনগণের কোনো বক্তব্য প্রকাশ করা হয়নি। তবে সেটলার বাঙালি সংগঠনের খবর ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে ১৪৪ ধারা জারি করার কথা একটু করে বলা হলেও প্রশাসনের আর কোনো ধরণের উদ্ধৃতি বা বক্তব্য প্রকাশ করা হয়নি।
No comments:
Post a Comment