Wednesday, March 27, 2013

লড়াকামী বিপ্লবী শক্তির প্রতি


 লড়াইকামী শক্তির প্রতি

বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্যিক পরিস্থিতিতে জনগনের লড়াইকামী শক্তির
বিভ্রান্ত হবার কোনো কারণ নেই, বরং লড়াইকে জনমানুষের কাতারে নেবার এখনই
যথার্থ সময়। অরূন্ধতী রায়ের লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আমি আমার এই
লেখাটি অবতারনা করছি।

প্রখ্যাত লেখক এবং সমাজসংশ্লিষ্ট মতামত প্রদানকারী ভারতীয় লেখা অরূন্ধতী
রায় তার এক লেখায় লিখেছেন, "ক্ষমতায় থাকা যে কারো জন্যই প্রধান কৌশল হলো
জাতিকে বিভক্ত রাখার পথ খোঁজা"।

এই বক্তব্যটি দেবার আগে তিনি ভারতের প্রসঙ্গ টেনে যা লিখেছেন তার উদ্ধৃতি দিচ্ছি।

"ভারতের বাজার যখন ১৯৯০-এর দশকে খুলে দেওয়া হয়, যখন সংরক্ষিত
শ্রম-সংক্রান্ত সব আইন বাতিল করা হয়, যখন প্রাকৃতিক সম্পদরাজি
বেসরকারিকরণ করা হয়, যখন পুরো প্রক্রিয়াকে গতিশীল করা হয়,

তখন ভারত সরকার দুটি তালা খুলে দিয়েছিল :

একটি ছিল বাজারের তালা;

আরেকটি ছিল ১৪ শতকের একটি পুরনো মসজিদের তালা, যা নিয়ে হিন্দু ও
মুসলমানদের মধ্যে বিতর্ক ছিল।

হিন্দুরা বিশ্বাস করত, এটা রামের জন্মস্থান, আর মুসলমানেরা এটাকে মসজিদ
হিসেবে ব্যবহার করত।

ওই তালা খুলে ভারত সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের
সংঘাত বেগবান করেছে, জাতিকে সদা বিভক্ত করার পথ সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতায়
থাকা যে কারো জন্যই প্রধান কৌশল হলো জাতিকে বিভক্ত রাখার পথ খোঁজা।"

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা অরূন্ধতী রায়ের যুক্তিকে
ভিত্তি হিসেবে ধরলে বর্তমান পরিস্থিতিকে আমরা কিভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি?

ক্ষমতাবান গোষ্ঠীসমূহের এমন একটি অস্ত্র বা ইস্যু বা জুজু বা শ্লোগান
দরকার যা দিয়ে সে একই সাথে লড়াইকামী শক্তিকে দাবাতে পারে এবং সাথে সাথে
তার ক্ষমতা কাঠামোকে ভিত্তি দান করতে জনগণকেও নিজের বলয়ে আনতে পারে।

সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিচার করলে বিদ্যমান শাসনকাঠামোর কর্তা
'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি' হিসেবে পরিচিত আওয়ামী মহাজোট সরকার
'যুদ্ধাপরাধীর বিচার'এর সাচ্চা আয়োজক, আর 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রক্ষক'
হিসেবে নিজেকে জাহির করার ইস্যুকে সামনে এনেছে। সাথে সাথে জনগণের
লড়াইকামী শক্তিকে দমানোর জন্যও তার কৌশল রয়েছে। তা হচ্ছে, ডিজিটাল যুগের
উদগাতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার সাথে সাথে ডিজিটালী
প্রচার-প্রোপাগান্ডাকে কর্তৃত্বাধীনে এনে লড়াইকামী জনগণের সচেতন অংশের
কন্ঠের টুঁটি চেপে ধরার কৌশলও তারা  সামনে এনে রেখেছে।

একই সাথে শাসকশ্রেনীর অন্য ক্ষমতাকাঠামোর দাবিদার অপেক্ষমান শক্তিও
কিন্তু কৌশল খাটাচ্ছে  ইস্যু সৃষ্টি করে তা নিজের আওতায় রাখার জন্য।
তাদের ইস্যু হচ্ছে, তারা 'গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হতে চায়', গণতন্ত্র
রক্ষার অন্যতম শর্ত হচ্ছে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন, এবং একমাত্র
'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই' দেশে সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে
পারে বলে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। একই সাথে তারা 'পার্শ্ববর্তী দেশের
হস্তক্ষেপ' জুজু ও 'নাস্তিক-ধর্মদ্রোহী' ইস্যুকে খুব সার্থকভাবে তুলে
এনেছে।

শেষের ইস্যুটি ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছেই বলে
মনেহয়। তবে এই বেকায়দা অবস্থান থেকে তারা কৌশল খাটিয়ে কায়দা করে
ইস্যুটিকে নিজের পক্ষে আনার চেষ্টাও তারা করছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই 'নাস্তিক' ইস্যুটিকে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী কব্জায়
নিয়ে সুদূরপ্রসারী লক্ষকে সামনে রেখে এগোচ্ছেই বলে মনেহয়। সাম্প্রতিক
সময়ে সরকার ঘোষণা করেছে, ব্লগে কী লেখালেখি হচ্ছে তা সরকার নজরদারী করবে।
আপাতভাবে 'ধর্মদ্রোহী' 'ইসলাম বিরোধী' লেখা বা মন্তব্য বা বক্তব্য
নজরদারীতে আনার কথা বলা হলেও কিন্তু তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে,
মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা বা প্রভাবান্বিত করা।

এই হচ্ছে বর্তমান বিবদমান শাসনচক্রলাভী বা প্রত্যাশী শক্তিসমূহের কৌশলগত অবস্থান।

তবে তাদের নীতিগত অবস্থান যে একই, এবং তা হচ্ছে, নৈরাজ্য বা বিশৃঙ্খলা বা
অস্থিতিশীলতা যা-ই সৃষ্টি হোক না কেন তাকে কিন্তু নিজের শ্রেণীস্বার্থের
বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া না হয় তা নিয়ে কিন্তু দুই পক্ষই যথষ্ট সতর্ক-সজাগ
এবং পরষ্পর সহযোগিতামূলক অবস্থানেই রয়েছেন।

কোথাকার কোন গার্মেন্টেস ফ্যাক্টরী পুড়ে গেলো, শত শত মানুষ পুড়ে অঙ্গার
হলো তা নিয়ে তাই সরকারী বিরোধী দলও ইস্যু বানায় না। গার্মেন্টসের মালিককে
রক্ষায় কিন্তু তারা দু'দলই একাট্টা। জনগণ সংশ্লিষ্ট যে কোন ইস্যুর দিকে
খেয়াল করলেই আপনি তার দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি পাবেন। তবে সতর্কতা হচ্ছে,
এক্ষেত্রে 'নাকি কান্না' বা 'মেকি সহমর্মিতা' বিষয়ে আপনাকে সজাগ বা সচেতন
থাকতে হবে।

এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, নৈরাজ্য বা বিশৃঙ্খলা বা অস্থিতিশীলতা বা
বিভক্তি সৃষ্টি শাসকশ্রেনীর ইচ্ছাপ্রসূত বা অনিচ্ছাপ্রসূত
ক্ষমতাকেন্দ্রীক আর্থরাজনৈতিক একটি বাস্তবতা। এর মর্মগত লক্ষ্য হচ্ছে
ক্ষমতাকে পোক্ত করা। সুতরাং এই 'নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি'তে বিভ্রান্ত হবার
কোনোই কারণ নেই।

সংক্ষেপে এই-ই হচ্ছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে শাসকগোষ্ঠীর
অবস্থান নিয়ে একটি সাদা বিশ্লেষণ।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যারা জনগণের কথা বলবেন বা যারা গণমানুষের
মর্মবেদনা-দৈনন্দিন শোষন-বঞ্চনার ভাষাকে ফুটিয়ে তুলবেন, যারা গণমানুষের
লড়াই গড়ে তুলবেন তাদের মধ্যেও কেমন যেন দিক-লক্ষ্য ভ্রান্তি, দিশাহারভাব
লক্ষ্য করা যায়।

লড়াকামীদের কাছে আহ্বান বা অনুরোধ, এখনই কিন্তু মাহেন্দ্রক্ষণ লড়াইকে
পোক্ত করার, জনমানুষের মাঝে লড়াইকামী শক্তিকে সাচ্চা হিসেবে তুলে ধরার।

সেই কাজ যারা করবেন তারাই হবেন আসল বিপ্লবী শক্তি। এখন যে ইস্যুটিকে নিয়ে
আপনি সোচ্চার হচ্ছেন সেই ইস্যুটিকে জনমানুষের ভাগ্য বদলের ইস্যু হিসেবে
প্রস্তুত করতে আপনাকেই হাতে-কলমে-বাস্তবে মাঠে নামতে হবে। নিপীড়িত
অত্যাচারিত জনতার একটিই মাত্র ইস্যু তা হচ্ছে
শোষণহীন-বঞ্চনাহীন-অন্যায়বিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জোরদার লড়াই করার
জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা, লড়াইকে সকল বাধাবিপত্তি মোকাবেলা করে সামনে
এগিয়ে নেয়া।

সবাইকে ধন্যবাদ

No comments:

Post a Comment

সর্বাধিক পঠিত

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষাঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসংগ-১৯৪৭ সাল

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষা তারিখঃ ১৬ আগস্ট, ২০১৭ ইতিহাস একটি জাতি বা জাতিসত্তা তথা জাতিসমষ্টিকে নানাভাবে প্রভাবিত কর...