সিঙ্গাপুর নামক রাষ্ট্রটি ক্ষুদ্র দ্বীপখন্ড বা দ্বীপখন্ডসমূহের সমষ্টি। প্রায় ৫৫ লাখ জনঅধ্যুষিত এই রাষ্ট্রটি বিশ্বের আর ২০০টি রাষ্ট্রেরই মতো একটি রাষ্ট্র। ১৯৬৫ সালের ০৯ আগস্ট এই রাষ্ট্রটি মালয় ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতা ঘোষনার সময় এই রাষ্ট্রটি বলতে গেলে একটি জেলে পল্লী মাত্র ছিল। লি কুয়ান ইউ তখন ছিলেন সেই জেলেপল্লীসম দ্বীপখন্ড বা দ্বীপখন্ডসমূহের ২০ লাখ মানুষের নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী। তার নেতৃত্বে সেই রাষ্ট্রটি মাত্র কয়েকবছরের মধ্যে উন্নতশীল ও বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে চলে আসে।সিঙ্গাপুরকে তিনি যেমন ন্যায়সংগত শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করান তেমনি তিনিও পরিচিতি লাভ করেন বিশ্বের মাঝে শক্তিশালী একজন রাষ্ট্রনায়ক তথা সরকার পরিচালক হিসেবে।
তাঁর সরকার পরিচালনার ধরণ বা তাঁর নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য বা নেতৃত্বের ধরণ নিয়েই এই আলোচনা। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরাও যদি কিছুটা শিক্ষা অর্জন করতে পারি তবে নিশ্চয়ই এই প্রচেষ্টা সার্থক হবে বলে আশা।
এখানে আমি মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক কর্তৃক ভাষান্তরকৃত লি কুয়ান ইউ’র আত্মকথা ‘ফ্রম থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফাস্ট ফাস্ট; সিঙ্গাপুরের ইতিহাসঃ ১৯৬৫-২০০০’ বই থেকে লেখার সারবস্তুসমূহ সংগ্রহ করেছি এবং তথ্যসহ উদ্ধৃতিসমূহও এই বই থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে।
বয়োকনিষ্ঠ নেতা থেকে সুযোগ্য রাষ্ট্র পরিচালক
লি কুয়ান ইউ যখন সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তার সাথে থাকা সহযোগীদের চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ ছিলেন।
তিনি ১৯৫৯ সালের দিকে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে স্বায়ত্তশাসিত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে যখন সিঙ্গাপুর মালয় ফেডারেশন থেকে স্বাধীন হয় তখন তার বয়স ছিল ৪২ বছর। তিনি ছিলেন তার সহকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী। দায়িত্ব গ্রহণ বিষয়ে তিনি লিখেছেন স্মৃতি কথায় লিখেছেন- ‘আমি তাঁদের সকলের চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ ছিলাম। তারপরেও তাঁরা কখনো আমার কোনো বিষয়ে বাধা দেননি, নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি। এমনকি আমি যখন কোনো ভুল করেছি তখনও তাঁরা আমার বিরোধিতা করেননি। তাঁরা সবসময় আমাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে অবস্থান করতে সহায়তা করেছেন এবং আমার ভেতরে যেন ‘মুই কি হনু রে’ জাতীয় ঝুঁকিপূর্ণ আত্মম্ভরিতার বিকাশ না ঘটে সে বিষয়ে সচেতন থেকেছেন।’(পৃ:২৯৪)
তিনি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তার কিছু কিছু আমি নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
সুশাসনের জন্য সুনেতৃত্ব অত্যাবশ্যক
তিনি সরকার বা রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে একই সাথে ভালো লোক ও সুনেতৃত্বের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলছেন- ‘আমি দেখেছি, সুগঠিত সরকার কাঠামোও যদি মন্দ লোকের দ্বারা পরিচালিত হয় তাতে করেও জনগণের ক্ষতিই সাধিত হয়। অন্যদিকে আমি অনেক সমাজে সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতা সত্ত্বেও সুনেতৃত্বের বদান্যতায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা হতে দেখেছি।’
এদিক থেকে তিনি ভালো একজন প্রশাসক ও সুনেতা অবশ্যই ছিলেন। প্রশাসন পরিচালনার সময় তিনি যেমন দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি করেননি তেমনি তার প্রশাসন বা সরকারে যেন সে ধরণের কিছু চলতে না পারে সে ব্যবস্থা তিনি করার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে তাকে আপাতভাবে নানা ‘বিতর্কিত’ সিদ্ধান্তও অনেক ক্ষেত্রে নিতে হয়েছে।
তিনি বলছেন- ‘… আমাদের মন্ত্রীপরিষদের সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী ছিলাম। অফিসের বাইরে আমাদের কোনো বৃত্তিগ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। আমাদের সকলের স্ত্রী উপার্জন করতেন, আমরা জেলে গেলে কাছাকাছি না থাকলে তাঁদের অর্থেই সংসারের খরচাপাতি মেটানো হত। এভাবেই আমাদের মন্ত্রী এবং তাঁদের স্ত্রীদের মানসিক গঠন গড়ে উঠেছিল। এ ধরণের পরিবেশে মন্ত্রীগণ যখন জনতার প্রতি আস্থাশীল থেকে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করত তখন আমলারাও নির্ভীক চিত্তে মাথা উঁচু করে আস্থার সাথে সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন।’(পৃঃ১৯৭)
তাঁর এবং তাঁর সহকর্মীদের এই ক্লিন ইমেজের কারণে তারা জনগণের মাঝে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
তিনি মন্ত্রীদের বেতন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া একনাগারে যারা ১০ বছরের মতো সংসদ সদস্য থাকতেন তাদের জন্য তনি পেনশনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
একইসাথে তিনি দেখেছেন, সাধারণভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হতে প্রার্থীদের বিস্তর খরচ করতে হত। এতে তারা নির্বাচিত হবার পরে সেই অর্থ আবার তুলে আনতে নানা ধরণের অনিয়মে জড়িত হতেন।
তিনি বলছেন- ‘বিশুদ্ধ সরকারের একটি অপরিহার্য শর্তই হচ্ছে নির্বাচনে অধিক ব্যয় না করা, কারণ ব্যয়িত অর্থ পুনরূদ্ধারের জন্য দুর্নীতির চক্রে আবর্তিত হতে হয়। এশিয়ার অধিকাংশ দেশের ধ্বংসের মূলে রয়েছে নির্বাচনে বেপরোয়া ব্যয়।’(পৃঃ ২০৩)
তিনি বলছেন- ‘নির্বাচনে অনাহুত ব্যয় করে কোনো সরকারই সততা রক্ষা করতে পারে না, এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর একটি পরিচ্ছন্ন পদ্ধতি প্রবর্তন করে সততার নজির স্থাপন করেছে।’(পৃঃ২০৩)
সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্ব সমর্পন
প্রশাসন বা সরকার বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিক বা দক্ষ যোগ্য ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্ব প্রদান করা সম্ভব হলে সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়। তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তাঁর নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। তিনি বলছেন- ‘যখনই আমি সঠিক ব্যক্তিকে কোনো দায়িত্বে ন্যস্ত করতাম তখনেই আমার ঘাড় থেকে একটি বোঝা নেমে যেত। আমি দায়িত্ব অর্পণকারীদের শুধু বিষয়বস্তু এবং কতদিনের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করতে হবে সে-সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা প্রদান করতাম, কাজটি সম্পাদনের তরিকা তারাই উদ্ভাবন করে তা সম্পন্ন করতেন।’
এভাবে তিনি সতর্কতার সাথে তার সহকর্মীদের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত করতে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন।কোন ব্যক্তি কী ধরণের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এ বিষয়ে সম্ভবত তাঁর সুচারু ধারণা বা জ্ঞান ছিল বলা যায়।
যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা
লি কুয়ান ইউ তার এক সহকর্মী’র গুণবাবলী সম্পর্কে বলছেন- ‘আমার মন্ত্রীদের মধ্যে হোন সুই সেন উপযুক্ত লোকবল অনুসন্ধানের কাজে সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন।’(পৃঃ ২৭৫)
তিনি গোহ চক তং-এর মতো একজন করিৎকর্মা নির্বাহীকে খুঁজে বের করেছিলেন। পরে গোহ চক তং প্রধানমন্ত্রী পদ অলংকৃত করেছিলেন।তিনি সুই সেন ও ডঃ তনি তান-এর মতো ব্যক্তিত্বকেও রাজনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত করেছিলেন। এই দুইজন পরবর্তিতে উপপ্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন।
এছাড়া সংযুক্ত করেছিলেন এস ধনবালানের মতো প্রজ্ঞাবানকেও। যিনি পরে সিঙ্গাপুর উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
নেতৃত্বের জন্য মেধার সাথে আরো যা কিছু প্রয়োজন
নেতৃত্ব প্রদানের জন্য মেধা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে তার অতিরিক্ত আরো বেশি কিছুরও প্রয়োজন রয়েছে।
লি কুয়ান উই জানাচ্ছেন- ‘অচিরেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে নেতৃত্বের জন্য মেধার বাইরেও অনেক কিছুর আবশ্যকতা অপরিহার্য। একজন মেধাবি ব্যক্তি তার প্রজ্ঞা দিয়ে যত সহজে ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ করতে পারে, যত সহজে একটি পিএইচডি থিসিস লিখতে পারে তত সহজভাবে গণনেতৃত্বে সফলতা অর্জন করতে পারে না। জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আরো অনেক কিছু প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন সাহসিকতা, আত্মপ্রত্যয়, দায়বদ্ধতা, সুচরিত্র এবং সক্ষমতা।
যেসব গুণের কারণে জনগণ নেতার পদাঙ্ক অনুসরণে অনুপ্রাণিত হয় সেসব গুণের অধিকারী হওয়া একজন নেতার জন্য অতীব জরুরি। এজন্য আমাদের এমন লোকের প্রয়োজন ছিল যিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তৎপর, সুবিবেচক এবং মানুষের সাথে মেলামেশায় দক্ষ।’
মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতাও নেতৃত্বের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় গুণাবলী
১৯৭০ সালে আমেরিকার মহাকাশযান এপোলো-১৩ মহাকাশে যায়।এই ঘটনাপ্রবাহ তখন টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল। লি কুয়ান ইউ তা দেখছিলেন। তিনি দেখলেন, পৃথিবী থেকে তিন লক্ষ মাইল দূরে থাকা মহাকাশযানটি কার্যকরভাবে কাজ করছিলো না। নভোচারীদের একজন সামান্য ভুল করেছিল এবং এতে সকলে বিপদের মধ্যে পড়ে। কিন্তু মহাকাশযানে থাকা সবাই একটুও বিচলিত না হয়ে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষের নির্দেশনা অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পালন করে যাচ্ছিল। শেষে তারা বিপর্যয়ের কবল থেকে রক্ষা পায়। মহাকাশে প্রেরণের আগে আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা নভোচরাদিদের মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতারও পরীক্ষা গ্রহণ করতো।
লি কুয়ান ইউ এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে তার সরকারে যারা নিযুক্ত হতেন তাদের তিনি মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতার পরীক্ষার ব্যবস্থা করতেন। তিনি লিখেছেন- এ ঘটনা পর্যবেক্ষণের পর আমি আমাদের সকল পর্যায়ের প্রার্থীদের মানসিক সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য মনোবিজ্ঞানী এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম।
মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, বুদ্ধিমত্তা, মূল্যবোধ ও জীবনাচার ইত্যাদি সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখা হতো। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিশ্লেষণ ক্ষমতা, তার দূরদৃষ্টি ও বাস্তব-সম্পর্কিত জ্ঞান এই গুণাবলী বিষয়েও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় পর্যবেক্ষণ করা হতো।
নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজ
১৯৭৪ সালে কোনো একদিন তিনি অর্থমন্ত্রী সুই সেন-এর সাথে আলাপ করছিলেন। সুই সেন তার কাছে আশংকা প্রকাশ করছেন যে, তাকে সম্ভবত আগামী সাধারণ নির্বাচনের পরে সরে দাঁড়াতে হতে পারে। কারণ তার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। তখন পর্যন্ত সুই সেনের বয়স ছিল ৬৫ বছর। লি কুয়ান ইউ জানাচ্ছেন সুই সেনের সাথে সেদিনের আলোচনা তার উপর প্রচন্ড প্রভাব পড়েছিল। তারপর থেকে তিনি নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী নির্বাচনের দিকে নজর দিতে থাকেন।
এরপর তিনি বলছেন- ‘আমাদের চূড়ান্ত কাজ ছিল শক্তিশালী উত্তরাধিকার গড়ে তোলা। মাও সেতুং এ সমস্যা উত্তরণের নিমিত্ত যোগ্য উত্তরাধিকার বিকাশের স্বার্থে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ছত্রছায়ায় লং মার্চের ডাক দিয়েছিলেন। আ্মাদের পক্ষ থেকে এমনটা করা সম্ভব ছিল না। সঠিক চরিত্রের নেতৃত্বের মাধ্যমে আমাদেরকে সমাধানের পথ খুঁজতে হয়েছিল, যারা সংকট মোকাবেলার মধ্য দিয়েই পরীক্ষিত নেতা হিসেবে বিকশিত হবে।’
তিনি বলছেন- ’আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নেতৃত্বের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি না করে নতুন রক্তের সঞ্চালন করা। এ প্রক্রিয়াতে প্রতিষ্ঠাপন প্রাক্কালে আমার অনেক পুরাতন সহকর্মীকে নিজেদের পদ ছেড়ে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল।’
তিনি নিজেকে তখন থেকেই ‘বয়স্কদের কাতারে ধাবিত’ হচ্ছিলেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলছেন, নিজেকে প্রতিদিন আয়নাতে দেখে আমিও আমার অবস্থান বুঝতে পারতাম। আমাকে আমি আর আগের মতো সপ্রতিভ, ক্লান্তিহীন এবং উদ্দীপ্ত ভাবতে পারতাম না। তার চেয়েও বড় কথা, প্রকাশিত প্রতিবেদন, ছবি ও ভিডিও-র প্রতি আমি আস্থাশীল ছিলাম এবং বয়সের ব্যাপারটি বুঝতে পারতাম।
তবে এই সময়ে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার ধরণ বা কৌশল কী ধরণের হবে নিয়ে তিনি তার সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা বাধা বিপত্তিরও সম্মুখীন হচ্ছিলেন। তার পুরাতন বয়স্ক সহকর্মীরা নতুনদের জায়গা ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তারা যেভাবে ‘তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে উঠে এসেছেন’ সেভাবেই তাদের উত্তরসূরীদের উঠে আসা দরকার বলে মনে করতেন।
কেউ কেউ মনে করতেন নতুনদের এত সহজভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে দেয়াটা ঠিক হবে না, তাদের আরো শেখা উচিত ও অপেক্ষা করা উচিত।
কিন্তু লি কুয়ান ইউ ভিন্নমত পোষন করতেন এবং সেভাবে্ই তিনি সিঙ্গাপুর পরিচালনার জন্য পরবর্তী নেতৃত্বকে গড়ে তুলেছেন। দেশ থেকে ও বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনি নির্বাচিত করেছিলেন এবং তারা পার্টিতে যোগদানের তিন চার বছরের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি বলছেন- ‘… আমি মনে করতাম নতুন জমানার মেধাবী ছেলেদের অপেক্ষা করবার মতো অবকাশ নেই, পার্টিতে রাখতে হলে ওদেরকে যথাযথ সুযোগ করে দিতে হবে, অন্যথায় ওরা ওদের পছন্দের পথে চলে যাবে।’
এভাবে তিনি সিঙ্গাপুরের যোগ্য উত্তরসূরী প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে এক কথায় বলা যায় ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তবে উত্তরাধিকার নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি যোগ্যতর নেতৃত্ব খুঁজতেও কড়া ধরণের পরীক্ষণ নিরীক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
রাষ্ট্রীয় বা সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ধান্ধাবাজিতে অনভ্যস্ত মেধাবী, আন্তরিক, কর্মদক্ষ এবং গতিশীল তরুণ কর্মকর্তাদের উপর’ তিনি ও তাঁর সরকার আস্থা রেখেছিলেন।’(পৃঃ ১০৭)
তিনি আরো বলছেন- ‘… নবনিযুক্তদের জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা এবং তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের সাথে সম্পৃক্ততার গুণাগুণ অর্জন করাটা ছিল অত্যাবশ্যক। যাদের ভেতর এ সমস্ত অতিরিক্ত গুণাবলী পরিদৃষ্ট হত আমি শুধু তাদেরকেই মন্ত্রীসভায় স্থান করেদিতাম।’
তিনি নিজেও নতুনদের জন্য তার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি জানাচ্ছেন- ‘আমি ৩১ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলাম। ইচ্ছে করলে আরো এক টার্মের জন্য প্রধানমন্ত্রীত্বের পদে বহাল থাকতে পারতাম। কিন্তু তাতে আমার সক্ষমতা ও কার্যকারিতার প্রমাণ ব্যতিরেকে তেমন কিছুই অর্জিত হত না, অন্যদিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে আমি যদি আমার উত্তরসূরিদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারি তা হলে তা-ই হবে সিঙ্গাপুরের জন্য অধিকতর কল্যাণকর, এ ধরণের চিন্তাভাবনা থেকেই আমি আর প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ ধরে রাখিনি।’
১৯৯০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ ছেড়েছিলেন।তবে তারপরও তিনি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
লি কুয়ান ইউ’র ন্যায়সংগত সমাজ গঠনের কাজ
লি কুয়ান ইউ জানাচ্ছেন যে, তারা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সমঅংশীদারিত্ব ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক একটি সমাজ গড়াতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু অর্থনীতির বিকাশের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিকাশ ও প্রণোদনার প্রয়োজন ছিল। তবে তিনি বলছেন- ‘সকলের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতা সমান নয়, এক্ষেত্রে যদি কর্মদক্ষতার আলোকে বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাপ্যতা নির্ধারিত হয় তাহলে কেউবা অধিক লাভবান হবে, কেউ বা মাঝারী লাভবান হবে এবং ব্যাপক সংখ্যক লোক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এতে করে সামাজিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাধাপ্রাপ্ত হবে।’(পৃঃ ১৩৫)
লি কুয়ান ইউ তাই রাষ্ট্রের অর্জিত সম্পদ সমভাবে বন্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন- ‘আমরা যদি আমাদের অর্জিত সম্পদ বিতরণে সমবন্টনের নীতি অনুসরণ না করতাম, তাহলে আমাদের জাতীয় সংহতির অনুভূতি দুর্বল হয়ে পড়ত এবং একটি সুনির্দিষ্ট অভীষ্টে চলার পথে হোঁচট খেত। আমি ব্যক্তি বিশেষের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে গোষ্ঠী সংহতির স্বার্থে তাওইজমের প্রতীক তথা দুটি মাছের মাধ্যমে একটি চক্রসদৃশ সমাজিক বন্ধন গড়ে তুলেছিলাম। এর একটি মাছ ছিল পুরুষসদৃশ এবং অন্যটি নারী। এক্ষেত্রে পরুষ মাছটি যদি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে সকল কিছু অর্জন করে নিত, তা হলে সামাজিক সংহতি দুর্বল হয়ে যেত, যে কারণে ভারসাম্য তথা সামাজিক সংহতি রক্ষার্থে আমরা নারী মাছটির অনুকূলেও সম্পদের অংশবিশেষ বিতরণ করেছিলাম।’ (পৃঃ ১৪৭)
লি কুয়ান ইউ’র নেতৃত্বের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে তাঁর রাজনৈতিক জীবনী পাঠ করা প্রয়োজনীয়। তিনি কিভাবে সমস্যার মীমাংসা করেছিলেন, কিভাবে তিনি বাস্তব পরিকল্পনা করেছিলেন এবং বাস্তব সমস্যাসমূহ বাস্তবে বাস্তবিকভাবে একে একে সমাধান করতে পেরেছিলেন এ বিষয়গুলো তার লিখিত বই বা তাকে নিয়ে লেখা বই থেকে জানা সম্ভব হবে। যারা নেতৃত্ব দিতে চান বা যারা সমাজের জন্য কিছু একটা করতে চান তারা লি কুয়ান ইউ’র এই নেতৃত্বের ধরণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবেন এই প্রত্যাশা থাকলো।
তাঁর সরকার পরিচালনার ধরণ বা তাঁর নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য বা নেতৃত্বের ধরণ নিয়েই এই আলোচনা। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরাও যদি কিছুটা শিক্ষা অর্জন করতে পারি তবে নিশ্চয়ই এই প্রচেষ্টা সার্থক হবে বলে আশা।
এখানে আমি মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক কর্তৃক ভাষান্তরকৃত লি কুয়ান ইউ’র আত্মকথা ‘ফ্রম থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফাস্ট ফাস্ট; সিঙ্গাপুরের ইতিহাসঃ ১৯৬৫-২০০০’ বই থেকে লেখার সারবস্তুসমূহ সংগ্রহ করেছি এবং তথ্যসহ উদ্ধৃতিসমূহও এই বই থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে।
বয়োকনিষ্ঠ নেতা থেকে সুযোগ্য রাষ্ট্র পরিচালক
লি কুয়ান ইউ যখন সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তার সাথে থাকা সহযোগীদের চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ ছিলেন।
তিনি ১৯৫৯ সালের দিকে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে স্বায়ত্তশাসিত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে যখন সিঙ্গাপুর মালয় ফেডারেশন থেকে স্বাধীন হয় তখন তার বয়স ছিল ৪২ বছর। তিনি ছিলেন তার সহকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী। দায়িত্ব গ্রহণ বিষয়ে তিনি লিখেছেন স্মৃতি কথায় লিখেছেন- ‘আমি তাঁদের সকলের চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ ছিলাম। তারপরেও তাঁরা কখনো আমার কোনো বিষয়ে বাধা দেননি, নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি। এমনকি আমি যখন কোনো ভুল করেছি তখনও তাঁরা আমার বিরোধিতা করেননি। তাঁরা সবসময় আমাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে অবস্থান করতে সহায়তা করেছেন এবং আমার ভেতরে যেন ‘মুই কি হনু রে’ জাতীয় ঝুঁকিপূর্ণ আত্মম্ভরিতার বিকাশ না ঘটে সে বিষয়ে সচেতন থেকেছেন।’(পৃ:২৯৪)
তিনি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তার কিছু কিছু আমি নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
সুশাসনের জন্য সুনেতৃত্ব অত্যাবশ্যক
তিনি সরকার বা রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে একই সাথে ভালো লোক ও সুনেতৃত্বের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলছেন- ‘আমি দেখেছি, সুগঠিত সরকার কাঠামোও যদি মন্দ লোকের দ্বারা পরিচালিত হয় তাতে করেও জনগণের ক্ষতিই সাধিত হয়। অন্যদিকে আমি অনেক সমাজে সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতা সত্ত্বেও সুনেতৃত্বের বদান্যতায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা হতে দেখেছি।’
এদিক থেকে তিনি ভালো একজন প্রশাসক ও সুনেতা অবশ্যই ছিলেন। প্রশাসন পরিচালনার সময় তিনি যেমন দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি করেননি তেমনি তার প্রশাসন বা সরকারে যেন সে ধরণের কিছু চলতে না পারে সে ব্যবস্থা তিনি করার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে তাকে আপাতভাবে নানা ‘বিতর্কিত’ সিদ্ধান্তও অনেক ক্ষেত্রে নিতে হয়েছে।
তিনি বলছেন- ‘… আমাদের মন্ত্রীপরিষদের সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী ছিলাম। অফিসের বাইরে আমাদের কোনো বৃত্তিগ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। আমাদের সকলের স্ত্রী উপার্জন করতেন, আমরা জেলে গেলে কাছাকাছি না থাকলে তাঁদের অর্থেই সংসারের খরচাপাতি মেটানো হত। এভাবেই আমাদের মন্ত্রী এবং তাঁদের স্ত্রীদের মানসিক গঠন গড়ে উঠেছিল। এ ধরণের পরিবেশে মন্ত্রীগণ যখন জনতার প্রতি আস্থাশীল থেকে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করত তখন আমলারাও নির্ভীক চিত্তে মাথা উঁচু করে আস্থার সাথে সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন।’(পৃঃ১৯৭)
তাঁর এবং তাঁর সহকর্মীদের এই ক্লিন ইমেজের কারণে তারা জনগণের মাঝে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
তিনি মন্ত্রীদের বেতন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া একনাগারে যারা ১০ বছরের মতো সংসদ সদস্য থাকতেন তাদের জন্য তনি পেনশনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
একইসাথে তিনি দেখেছেন, সাধারণভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হতে প্রার্থীদের বিস্তর খরচ করতে হত। এতে তারা নির্বাচিত হবার পরে সেই অর্থ আবার তুলে আনতে নানা ধরণের অনিয়মে জড়িত হতেন।
তিনি বলছেন- ‘বিশুদ্ধ সরকারের একটি অপরিহার্য শর্তই হচ্ছে নির্বাচনে অধিক ব্যয় না করা, কারণ ব্যয়িত অর্থ পুনরূদ্ধারের জন্য দুর্নীতির চক্রে আবর্তিত হতে হয়। এশিয়ার অধিকাংশ দেশের ধ্বংসের মূলে রয়েছে নির্বাচনে বেপরোয়া ব্যয়।’(পৃঃ ২০৩)
তিনি বলছেন- ‘নির্বাচনে অনাহুত ব্যয় করে কোনো সরকারই সততা রক্ষা করতে পারে না, এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর একটি পরিচ্ছন্ন পদ্ধতি প্রবর্তন করে সততার নজির স্থাপন করেছে।’(পৃঃ২০৩)
সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্ব সমর্পন
প্রশাসন বা সরকার বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিক বা দক্ষ যোগ্য ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্ব প্রদান করা সম্ভব হলে সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়। তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তাঁর নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। তিনি বলছেন- ‘যখনই আমি সঠিক ব্যক্তিকে কোনো দায়িত্বে ন্যস্ত করতাম তখনেই আমার ঘাড় থেকে একটি বোঝা নেমে যেত। আমি দায়িত্ব অর্পণকারীদের শুধু বিষয়বস্তু এবং কতদিনের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করতে হবে সে-সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা প্রদান করতাম, কাজটি সম্পাদনের তরিকা তারাই উদ্ভাবন করে তা সম্পন্ন করতেন।’
এভাবে তিনি সতর্কতার সাথে তার সহকর্মীদের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত করতে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন।কোন ব্যক্তি কী ধরণের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এ বিষয়ে সম্ভবত তাঁর সুচারু ধারণা বা জ্ঞান ছিল বলা যায়।
যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা
লি কুয়ান ইউ তার এক সহকর্মী’র গুণবাবলী সম্পর্কে বলছেন- ‘আমার মন্ত্রীদের মধ্যে হোন সুই সেন উপযুক্ত লোকবল অনুসন্ধানের কাজে সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন।’(পৃঃ ২৭৫)
তিনি গোহ চক তং-এর মতো একজন করিৎকর্মা নির্বাহীকে খুঁজে বের করেছিলেন। পরে গোহ চক তং প্রধানমন্ত্রী পদ অলংকৃত করেছিলেন।তিনি সুই সেন ও ডঃ তনি তান-এর মতো ব্যক্তিত্বকেও রাজনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত করেছিলেন। এই দুইজন পরবর্তিতে উপপ্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন।
এছাড়া সংযুক্ত করেছিলেন এস ধনবালানের মতো প্রজ্ঞাবানকেও। যিনি পরে সিঙ্গাপুর উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
নেতৃত্বের জন্য মেধার সাথে আরো যা কিছু প্রয়োজন
নেতৃত্ব প্রদানের জন্য মেধা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে তার অতিরিক্ত আরো বেশি কিছুরও প্রয়োজন রয়েছে।
লি কুয়ান উই জানাচ্ছেন- ‘অচিরেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে নেতৃত্বের জন্য মেধার বাইরেও অনেক কিছুর আবশ্যকতা অপরিহার্য। একজন মেধাবি ব্যক্তি তার প্রজ্ঞা দিয়ে যত সহজে ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ করতে পারে, যত সহজে একটি পিএইচডি থিসিস লিখতে পারে তত সহজভাবে গণনেতৃত্বে সফলতা অর্জন করতে পারে না। জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আরো অনেক কিছু প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন সাহসিকতা, আত্মপ্রত্যয়, দায়বদ্ধতা, সুচরিত্র এবং সক্ষমতা।
যেসব গুণের কারণে জনগণ নেতার পদাঙ্ক অনুসরণে অনুপ্রাণিত হয় সেসব গুণের অধিকারী হওয়া একজন নেতার জন্য অতীব জরুরি। এজন্য আমাদের এমন লোকের প্রয়োজন ছিল যিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তৎপর, সুবিবেচক এবং মানুষের সাথে মেলামেশায় দক্ষ।’
মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতাও নেতৃত্বের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় গুণাবলী
১৯৭০ সালে আমেরিকার মহাকাশযান এপোলো-১৩ মহাকাশে যায়।এই ঘটনাপ্রবাহ তখন টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল। লি কুয়ান ইউ তা দেখছিলেন। তিনি দেখলেন, পৃথিবী থেকে তিন লক্ষ মাইল দূরে থাকা মহাকাশযানটি কার্যকরভাবে কাজ করছিলো না। নভোচারীদের একজন সামান্য ভুল করেছিল এবং এতে সকলে বিপদের মধ্যে পড়ে। কিন্তু মহাকাশযানে থাকা সবাই একটুও বিচলিত না হয়ে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষের নির্দেশনা অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পালন করে যাচ্ছিল। শেষে তারা বিপর্যয়ের কবল থেকে রক্ষা পায়। মহাকাশে প্রেরণের আগে আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা নভোচরাদিদের মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতারও পরীক্ষা গ্রহণ করতো।
লি কুয়ান ইউ এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে তার সরকারে যারা নিযুক্ত হতেন তাদের তিনি মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতার পরীক্ষার ব্যবস্থা করতেন। তিনি লিখেছেন- এ ঘটনা পর্যবেক্ষণের পর আমি আমাদের সকল পর্যায়ের প্রার্থীদের মানসিক সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য মনোবিজ্ঞানী এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম।
মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, বুদ্ধিমত্তা, মূল্যবোধ ও জীবনাচার ইত্যাদি সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখা হতো। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিশ্লেষণ ক্ষমতা, তার দূরদৃষ্টি ও বাস্তব-সম্পর্কিত জ্ঞান এই গুণাবলী বিষয়েও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় পর্যবেক্ষণ করা হতো।
নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজ
১৯৭৪ সালে কোনো একদিন তিনি অর্থমন্ত্রী সুই সেন-এর সাথে আলাপ করছিলেন। সুই সেন তার কাছে আশংকা প্রকাশ করছেন যে, তাকে সম্ভবত আগামী সাধারণ নির্বাচনের পরে সরে দাঁড়াতে হতে পারে। কারণ তার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। তখন পর্যন্ত সুই সেনের বয়স ছিল ৬৫ বছর। লি কুয়ান ইউ জানাচ্ছেন সুই সেনের সাথে সেদিনের আলোচনা তার উপর প্রচন্ড প্রভাব পড়েছিল। তারপর থেকে তিনি নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী নির্বাচনের দিকে নজর দিতে থাকেন।
এরপর তিনি বলছেন- ‘আমাদের চূড়ান্ত কাজ ছিল শক্তিশালী উত্তরাধিকার গড়ে তোলা। মাও সেতুং এ সমস্যা উত্তরণের নিমিত্ত যোগ্য উত্তরাধিকার বিকাশের স্বার্থে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ছত্রছায়ায় লং মার্চের ডাক দিয়েছিলেন। আ্মাদের পক্ষ থেকে এমনটা করা সম্ভব ছিল না। সঠিক চরিত্রের নেতৃত্বের মাধ্যমে আমাদেরকে সমাধানের পথ খুঁজতে হয়েছিল, যারা সংকট মোকাবেলার মধ্য দিয়েই পরীক্ষিত নেতা হিসেবে বিকশিত হবে।’
তিনি বলছেন- ’আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নেতৃত্বের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি না করে নতুন রক্তের সঞ্চালন করা। এ প্রক্রিয়াতে প্রতিষ্ঠাপন প্রাক্কালে আমার অনেক পুরাতন সহকর্মীকে নিজেদের পদ ছেড়ে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল।’
তিনি নিজেকে তখন থেকেই ‘বয়স্কদের কাতারে ধাবিত’ হচ্ছিলেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলছেন, নিজেকে প্রতিদিন আয়নাতে দেখে আমিও আমার অবস্থান বুঝতে পারতাম। আমাকে আমি আর আগের মতো সপ্রতিভ, ক্লান্তিহীন এবং উদ্দীপ্ত ভাবতে পারতাম না। তার চেয়েও বড় কথা, প্রকাশিত প্রতিবেদন, ছবি ও ভিডিও-র প্রতি আমি আস্থাশীল ছিলাম এবং বয়সের ব্যাপারটি বুঝতে পারতাম।
তবে এই সময়ে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার ধরণ বা কৌশল কী ধরণের হবে নিয়ে তিনি তার সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা বাধা বিপত্তিরও সম্মুখীন হচ্ছিলেন। তার পুরাতন বয়স্ক সহকর্মীরা নতুনদের জায়গা ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তারা যেভাবে ‘তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে উঠে এসেছেন’ সেভাবেই তাদের উত্তরসূরীদের উঠে আসা দরকার বলে মনে করতেন।
কেউ কেউ মনে করতেন নতুনদের এত সহজভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে দেয়াটা ঠিক হবে না, তাদের আরো শেখা উচিত ও অপেক্ষা করা উচিত।
কিন্তু লি কুয়ান ইউ ভিন্নমত পোষন করতেন এবং সেভাবে্ই তিনি সিঙ্গাপুর পরিচালনার জন্য পরবর্তী নেতৃত্বকে গড়ে তুলেছেন। দেশ থেকে ও বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনি নির্বাচিত করেছিলেন এবং তারা পার্টিতে যোগদানের তিন চার বছরের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি বলছেন- ‘… আমি মনে করতাম নতুন জমানার মেধাবী ছেলেদের অপেক্ষা করবার মতো অবকাশ নেই, পার্টিতে রাখতে হলে ওদেরকে যথাযথ সুযোগ করে দিতে হবে, অন্যথায় ওরা ওদের পছন্দের পথে চলে যাবে।’
এভাবে তিনি সিঙ্গাপুরের যোগ্য উত্তরসূরী প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে এক কথায় বলা যায় ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তবে উত্তরাধিকার নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি যোগ্যতর নেতৃত্ব খুঁজতেও কড়া ধরণের পরীক্ষণ নিরীক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
রাষ্ট্রীয় বা সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ধান্ধাবাজিতে অনভ্যস্ত মেধাবী, আন্তরিক, কর্মদক্ষ এবং গতিশীল তরুণ কর্মকর্তাদের উপর’ তিনি ও তাঁর সরকার আস্থা রেখেছিলেন।’(পৃঃ ১০৭)
তিনি আরো বলছেন- ‘… নবনিযুক্তদের জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা এবং তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের সাথে সম্পৃক্ততার গুণাগুণ অর্জন করাটা ছিল অত্যাবশ্যক। যাদের ভেতর এ সমস্ত অতিরিক্ত গুণাবলী পরিদৃষ্ট হত আমি শুধু তাদেরকেই মন্ত্রীসভায় স্থান করেদিতাম।’
তিনি নিজেও নতুনদের জন্য তার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি জানাচ্ছেন- ‘আমি ৩১ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলাম। ইচ্ছে করলে আরো এক টার্মের জন্য প্রধানমন্ত্রীত্বের পদে বহাল থাকতে পারতাম। কিন্তু তাতে আমার সক্ষমতা ও কার্যকারিতার প্রমাণ ব্যতিরেকে তেমন কিছুই অর্জিত হত না, অন্যদিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে আমি যদি আমার উত্তরসূরিদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারি তা হলে তা-ই হবে সিঙ্গাপুরের জন্য অধিকতর কল্যাণকর, এ ধরণের চিন্তাভাবনা থেকেই আমি আর প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ ধরে রাখিনি।’
১৯৯০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ ছেড়েছিলেন।তবে তারপরও তিনি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
লি কুয়ান ইউ’র ন্যায়সংগত সমাজ গঠনের কাজ
লি কুয়ান ইউ জানাচ্ছেন যে, তারা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সমঅংশীদারিত্ব ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক একটি সমাজ গড়াতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু অর্থনীতির বিকাশের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিকাশ ও প্রণোদনার প্রয়োজন ছিল। তবে তিনি বলছেন- ‘সকলের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতা সমান নয়, এক্ষেত্রে যদি কর্মদক্ষতার আলোকে বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাপ্যতা নির্ধারিত হয় তাহলে কেউবা অধিক লাভবান হবে, কেউ বা মাঝারী লাভবান হবে এবং ব্যাপক সংখ্যক লোক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এতে করে সামাজিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাধাপ্রাপ্ত হবে।’(পৃঃ ১৩৫)
লি কুয়ান ইউ তাই রাষ্ট্রের অর্জিত সম্পদ সমভাবে বন্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন- ‘আমরা যদি আমাদের অর্জিত সম্পদ বিতরণে সমবন্টনের নীতি অনুসরণ না করতাম, তাহলে আমাদের জাতীয় সংহতির অনুভূতি দুর্বল হয়ে পড়ত এবং একটি সুনির্দিষ্ট অভীষ্টে চলার পথে হোঁচট খেত। আমি ব্যক্তি বিশেষের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে গোষ্ঠী সংহতির স্বার্থে তাওইজমের প্রতীক তথা দুটি মাছের মাধ্যমে একটি চক্রসদৃশ সমাজিক বন্ধন গড়ে তুলেছিলাম। এর একটি মাছ ছিল পুরুষসদৃশ এবং অন্যটি নারী। এক্ষেত্রে পরুষ মাছটি যদি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে সকল কিছু অর্জন করে নিত, তা হলে সামাজিক সংহতি দুর্বল হয়ে যেত, যে কারণে ভারসাম্য তথা সামাজিক সংহতি রক্ষার্থে আমরা নারী মাছটির অনুকূলেও সম্পদের অংশবিশেষ বিতরণ করেছিলাম।’ (পৃঃ ১৪৭)
লি কুয়ান ইউ’র নেতৃত্বের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে তাঁর রাজনৈতিক জীবনী পাঠ করা প্রয়োজনীয়। তিনি কিভাবে সমস্যার মীমাংসা করেছিলেন, কিভাবে তিনি বাস্তব পরিকল্পনা করেছিলেন এবং বাস্তব সমস্যাসমূহ বাস্তবে বাস্তবিকভাবে একে একে সমাধান করতে পেরেছিলেন এ বিষয়গুলো তার লিখিত বই বা তাকে নিয়ে লেখা বই থেকে জানা সম্ভব হবে। যারা নেতৃত্ব দিতে চান বা যারা সমাজের জন্য কিছু একটা করতে চান তারা লি কুয়ান ইউ’র এই নেতৃত্বের ধরণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবেন এই প্রত্যাশা থাকলো।
ধন্যবাদ
ReplyDelete