সিঙ্গাপুর নামে এক ছোট দ্বীপখন্ড
বেশ কয়েক দশক আগেও এই দ্বীপখন্ড ছিলো জেলেদের মাছ ধরার এক জনপদ। ১৮১৯ সালে ব্রিটিশরাজ এই অঞ্চলকে ব্যবসায়িক কলোনী হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আয়তন ৭১৬ বর্গকিলোমিটারের(২৭৭ বর্গমাইল) কিছু বেশি। জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৫৫ লাখের মতো।জনপদে বসবাস করছেন মালয়ী-তামিল-চীনা এই তিন জাতির জনগণ। তবে প্রাপ্ত এক ডাটায় দেখা যায় সিঙ্গাপুরের মোট শ্রমশক্তির ৪৪ ভাগই বর্তমানে অন্য দেশ বা জাতি থেকে আগত।
১৯৪২ সালের দিকে জাপান এই অঞ্চল ব্রিটিশরাজ থেকে দখলে নেয়। ১৯৪৫ সালে জাপানের কাছ থেকে আবার তা ব্রিটিশদের হাতে চলে আসে। ১৯৫৫ সালে সিঙ্গাপুরকে স্বশাসনের অধিকার দেয়া হয়। ১৯৬৩ সালে এই্ অঞ্চলটি স্বেচ্ছায় মালয়েশিয়ার সাথে অঙ্গীভূত হয়। ১৯৬৫ সালের ০৯ আগস্ট এই অঞ্চল বিশ্বের আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এরই মাঝে ১৯৫৪ সালে লি কুয়ান ইয়ু People’s Action Party (PAP) গঠন করেন। তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৫৯ সালের নির্বাচনে তার দল সিঙ্গাপুরের ক্ষমতায় আসে। এবং তার নেতৃত্বেই সিঙ্গাপুর স্বাধীনতা লাভ করে।
স্বপ্নছোঁয়া বাস্তববাদী লি কুয়ানের অগ্রাভিযান!
১৯২৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি চীনা এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক নাম হ্যারী লি কুয়ান ইয়ু। সিঙ্গাপুরের ইংলিশ স্কুলে তিনি ভর্তি হন। সিঙ্গাপুরে জাপান ও ব্রিটিশরাজের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়। এরপর তিনি কিছুদিন জাপানী প্রচারণা বিভাগের একজন সদস্য হিসেবে নিজের ইংরিজী শেখা জ্ঞানকে কাজে লাগান।
এরপর তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। পরে ক্যাম্ব্রিজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি সমাজবাদী ভাবাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। (তথ্যসূত্র: বিবিসি)
১৯৬৭ সাল। হাভার্ড ইউনিভার্সিটিতে বক্তব্যে তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। তার বক্তব্যটি এতটাই আকর্ষণীয় ছিল। পরদিন ক্রিমসন ইউনিভার্সিটির প্রকাশিত সংবাদপত্রে বলা হয়েছিল, ‘নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ একদিন শুধু তার দেশের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের গুটিকয়েক রাষ্ট্রনায়কের একজন হবেন, যারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে স্বদেশের উন্নতি ঘটাতে পারবেন। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাই তাকে একজন শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে গড়ে তুলবে।‘ (তথ্য সৌজন্য: বণিক বার্তা)
১৯৫৯ থেকে ১৯৯০ প্রায় ৩১ বছর তিনি সিঙ্গাপুরের কর্তৃত্ববাদী প্রশাসক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সিঙ্গাপুর শাসন করেন। প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে অবসর নেবার পরও তিনি সাধারণভাবে সংসদের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যান।
তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় সিঙ্গাপুরকে বৈষয়িক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সোপান সীমায় নিয়ে যান। যে দেশ দারিদ্র্য প্রপিড়ীত এক দেশ হিসেবে বিবেচিত ছিল তিনি তার কর্তৃত্ববাদী শাসন শৃঙ্খলের দ্বারা তিনি সেই নগর সদৃশ সম্পনন্ন রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধিসম্পন্ন উন্নত এক নগররাষ্ট্রে তার দেশকে পরিণত করেন। তাঁর বাস্তববাদীতার কারণে তিনি সম্মান ও মর্যাদা সমীহবোধ অর্জন করেছেন। কিন্তু তারপরেও তিনি বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারেননি। তার রাষ্ট্রে তিনি সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেননি।
স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ার সুযোগ না দিয়ে তিনি তাঁর সমালোচনাকারীদের শাস্তি প্রদান করেছেন। তিনি দেশি-বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের প্রকাশনা অবাধ করতে দেননি। তিনি অনেক সাংবাদিককে জেলে পুরেছেন। তিনি বলেছেন, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বা সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতাকে অবশ্যই সিঙ্গাপুরের একত্ববাদী চেতনার প্রয়োজনবোধের কাছে মাথা নিচু বা হেঁট করে রাখতে হবে। (“Freedom of the press, freedom of the news media, must be subordinated to the overriding needs of the integrity of Singapore,” he said.)
তিনি বলেছিলেন, সিঙ্গাপুরের অগ্রগতির স্বার্থে কিছু স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে বা সমর্পন করতে হবে ।
সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি
১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে জনপ্রতি জিডিপি ছিল ৫১১ আমেরিকান ডলার। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫১৮২ ডলারে।
১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে জিএনপি বেড়েছে ১৫ গুণ।
হংকং এর পরে বিশ্বের মধ্যে এই দেশটিই সবথেকে উন্মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত।
নিউজিল্যান্ড ও স্কান্ডিনেভিয়ান দেশের মত সবচেয়ে কম দুর্নীতিপিষ্ট দেশ হলো সিঙ্গাপুর। দেশের নেতা মন্ত্রীরা যেন দুর্নীতিতে না জড়ায় তার জন্য মন্ত্রীদের বেতন করেছিলেন ১০ লাখ ডলার।
এই দেশটি বিশ্বের ১৪তম বৃহত্তম রপ্তানীকারক দেশ এবং ১৫তম বৃহত্তম আমদানীকারক দেশ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে দেশটি বিশ্বের ১১তম।
কিন্তু তারপরও এই দেশটি শ্রম শোষনমূলক দেশ অপেক্ষা অধিক কল্যাণমুখী দেশ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে হয়তোবা।
এই দেশটিতে ৫০ শতাংশ বা অর্ধেক জায়গা বৃক্ষ আচ্ছাদিত সবুজ গাছ গাছালিতে ভরা। ছোটো এই দেশে ৫০টির অধিক পার্ক রয়েছে।
এই দেশের জনগণ আবাসন সুবিধা পেয়ে থাকে। সরকার এই অঞ্চলের জনগণে জন্য নিজ উদ্যোগে বাড়ি তৈরি করে দেয়।
স্বাস্থ্য সুবিধা নাগালের বাইরে নয়।
নেশা মাদকের হার কম।লি কুয়ান প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় নিষিদ্ধ করেছিলেন জিউকবক্স, চুইংগাম ও প্লেবয় ম্যাগাজিন।
সেই লি কুয়ান ইয়ু মারা গেলেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর । স্বাভাবিক বয়সেই তিনি মারা গেলেন। তার নিউমোনিয়া হয়েছিল। তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। হাসপাতালের বেডে তাঁর মৃত্যু হলো।
তিনি ছিলেন তামিল মালয় চাইনিজ ইংরেজি ভাষায় দক্ষ। তিনি একজন একনায়ক। তিনি কর্তৃত্ববাদী। তিনি আধুনিক সিঙ্গাপুরের রূপকার, আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক।তিনি কঠোর একজন প্রশাসক। তিনি ‘একজন বীর, তিনি একজন নেতা‘। তিনি ‘ইতিহাসের বিশাল ব্যক্তিত্ব‘। তিনি ‘ বহুল সম্মানিত পরিকল্পনাবিদ এবং রাষ্ট্রনেতা’। তিনি বিশ্ব রাজনীতির একজন ‘অভিভাবক’ । তিনি স্বপ্নপূরণকারী! তিনি স্বাপ্নিক। তিনি বাস্তববাদী। এভাবেই মৃত এই লি কুয়ানকে নানা অভিধায় সম্মানিত করেছন বিশ্বের নেতা-রাষ্ট্রনায়ক-জনগণ।
কিন্তু তিনি যা বলেছেন তাই করেছেন, তাই তিনি বলেছেন,
তিনি মানে লি কুয়ান ইয়ু ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছন কী না তা ভবি’র হাতে রেখে দিলাম আমরা!
No comments:
Post a Comment